[থাইল্যান্ডে (সায়াম বা শ্যামদেশ) আমার দিনযাপনের টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো একদিন হয়তো মলিন বিবর্ণ হয়ে যাবে, এখনই অনেকটা হয়েছে। যেটুকু স্মৃতিতে আছে তার কিছুটা তুলে রাখতে চাই 'শ্যামরাজ্যের গল্প' হিসেবে ছোট ছোট পর্বে। ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় নয়, যখন যা মনে পড়ে তাই লিখবার ইচ্ছে। আমার ছেলে-মেয়ের প্রায় কিছুই আর মনে পড়েনা, আর কারো না হোক একদিন তাদেরই হয়তো গল্পগুলো পড়তে ভালো লাগবে, মনে করার চেষ্টা করবে অতিশৈশবের দিনগুলো]
আগের পর্বঃ শ্যামরাজ্যের গল্পঃ সার্ভাইভাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাক

বেওয়ারিস কুকুরের এমন দোর্দন্ড প্রতাপ বাংলাদেশে কখনো দেখিনি। দেশের প্রভূহীন সারমেয়কূল এমনই নিরীহ দন্তহীন যে আমরা প্রভূহীন আর নেড়ি কুকুর প্রায় সমার্থক করে ফেলেছি। একমাত্র পাগল বা সদ্য মা হওয়া ছাড়া এ প্রাণিকূলের কোন বেওয়ারিস সদস্যকে সচরাচর মানুষের মুখোমুখি দাঁড়াতে দেখা যায়না। মানুষের চলাচলের জন্য কাঁইকুঁই করলেও ঘুম ভেঙ্গে হলেও ওরা পথ ছেড়ে দেয়, 'ঘেউ' করলেও নিরাপদ দুরত্বে গিয়ে করে। বাংলাদেশে মেজাজ দেখাবার অধিকার আছে কেবলই সাহেবী কুকুরের।



থাইল্যান্ডে গিয়েই টের পেলাম প্রভূহীন মানেই নেড়ি কুকুর নয় যে আমাকে দেখে সমীহ করে পথ ছেড়ে দেবে। দেশের কুকুরের মতো ওরা হাড্ডিসারও নয়, রীতিমত হৃষ্টপুষ্ট, চলেও বেশিরভাগ দলবেঁধে। ট্রাভেল গাইডে বাংলাদেশের জন্য যেমন লিখে দেয়া থাকে 'ক্যামেরা, ব্যাগ ও পকেট সাবধান', তেমনি থাইল্যান্ডের জন্যও সাবধানবাণী থাকে 'কুকর হইতে সাবধান'। এমনিতেই আমি কুকুর ভয় পাওয়া মানুষ। ছেলেবেলায় দু'দুবার দংশিত হবার ভীতি এ জীবনে আমার আর যাবেনা, বরং আমার ভীতি সঞ্চারিত হয়েছে পরের প্রজন্মে।

গল্পে ফিরি। গ্রাজুয়েশন শেষ হবার এক কি দু'দিনের মাঝে গ্রাজুয়েটদের ফ্যামিলি হাউজ ও সিঙ্গল স্টুডেন্ট ডর্ম ছেড়ে দেয়া নিয়ম, সবাই এ সময়ের মধ্যেই নিজ নিজ দেশে ফিরে যায়। আমরাও সেমতই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এরই মাঝে একজন মার্কিন অধ্যাপক যিনি ভিয়েতনাম সরকারের হয়ে একটি জলবিদ্যুৎ ও ড্যাম প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই-এর কাজ করছিলেন, তার একটি ছোট অংশের কাজ করে দেয়ার জন্য আমাকে খুঁজে পেলেন, অনেকটা সাব-কন্ট্র্যাক্ট। ঠিক হোল একমাসের মধ্যে আমি কাজ নামিয়ে দেব। হাউজ যেহেতু ছেড়ে দিতে হচ্ছে, তাই ক্যাম্পাসের অদুরে হাইওয়ের উল্টোদিকে বান ননথাপর্ন অ্যাপার্টমেন্টে একমাসের জন্য একটি ঘর নিয়ে নিলাম। আমার থিসিস সুপারভাইজার দয়া পরবশ হয়ে তাঁর জার্নাল অফিসের এক কোণে আমার জন্য একটি ওয়র্কস্টেশনও বরাদ্দ দিলেন। শুরু হোল আমার নিত্য অ্যাপার্টমেন্ট টু ডিপার্টমেন্ট যাতায়াত। কুকুর নিয়ে বিপত্তিটা এখানেই।

বিশাল বড় হাইওয়েটা পার হতে হয় ফুট ওভারব্রীজ দিয়ে। বাইক ওভারব্রীজ না থাকায় সাইকেলটা রাখতে হবে যে কোন এক পাড়ে, অন্য পাড়ে হাটতে হবে প্রায় সমান দুরত্ব, আধ-কিলোমিটারের মত। কাজের ফাঁকে ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরির সুবিধার কথা মাথায় রেখে সাইকেলটা রাখলাম ক্যাম্পাসের পাড়েই, কাজেই ওপাশে বাসায় যাওয়া-আসা হেটে। যেখানে বাঘের ভয় সন্ধা তো সেখানে নামবেই! ওভারব্রীজ থেকে বাসা পর্যন্ত যেতে দুটো স্পটে দুই দল কুকরের স্থায়ী আড্ডাখানা! প্রথম দিনের প্রাণ-খাঁচা-ছাড়া অভিজ্ঞতার পর থেকে আড্ডখানাগুলো পার হবার জন্য অন্য কারো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। কোনো থাই লোক ওদিকে যাচ্ছে দেখলেই তার সঙ্গ নিতাম। কুকুরগুলোও ওমনই বজ্জাত যে বিদেশী লোক ঠিকই চিনতো। থাইয়েরা থাই ভাষায় কিছু একটা বলতো, তাতেই ওরা শান্ত হয়ে যেত। ভাবতাম, তাইতো! দেশের কুকর বাংলা ধমক বোঝে, ইংরেজের কুকুর ইংরেজী ধমক, থাই কুকুর থাই ধমকই বুঝবে। আগে বুঝলে সার্ভাইভাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাকে দুটো কুকুরের ধমকও সংগ্রহ করে রাখতাম।

দ্বিতীয় আড্ডখানাটা ছিলো হাইওয়ে থেকে আমার অ্যাপার্টমেন্টগামী গলিপথে ঢুকতেই। বউ-বাচ্চাদের নিয়ে যে কোথাও গেলেই এ পথটুকু পাড়ি দেয়া ছিলো জীবনের কঠিনতম পরীক্ষাগুলোর একটি। চারদিক থেকে ৮-১০টা কুকুর ছুটে এসেই প্রায় গায়ে উঠে পড়ে মতো অবস্থা, অবিরাম চিৎকারতো আছেই। নিয়ম হলো, কুকুরের আক্রমন হওয়া মাত্র সঙ্গীরা তিনজনই ভয়ে আমাকে আকড়ে ধরবে, বাচ্চা দুটো গাছ বাওয়ার মতো আমার গা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করবে, আর আমি ভেতরে ভেতরে মরে শেষ হয়ে গেলেও বাইরে সাহস দেখিয়ে বাংলা-ইংরেজী মিশিয়ে কুকুরদের ধমক ধামক দিয়ে যেতে হবে, সঙ্গীদের সাহসও (!) দিতে হবে।

যাহোক, দু'চার দিনের মধ্যে পাড়ার কুকুরদের ঠিকান জেনে গেলাম, কে কোন বিল্ডিং-এর নিচে থাকে। আমাদের বিল্ডিং-এর নিচেই থাকতো সাদামতো বিশালদেহী একটা কুকুর। কিছুটা হয়তো চিনেও গিয়ে থাকবে আমাদের, তাই ওকে আর কখনো আক্রমনে সামিল হতে দেখতাম না। এই আত্মীয়তার ব্যাপারটা নজরে পড়ে গেলো আমার ৬ ও ৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়েরও। একদিন বিকেলে বাইরে যাবো বলে তৈরী হচ্ছি, ছেলেমেয়েরা আগেই তৈরী হয়ে নিচে নেমে গিয়েছে। আমি যখন নামলাম তখন দেখলাম আমার দু'ছেলেমেয়ে অলস বসে থাকা সাদা কুকুরটিকে কাতর হয়ে বলছে, কুকুর ভাই, আমরা তো তোমাদের বাসাতেই থাকি। অন্য বাসার কুকুর যখন আমাদের কামড়াতে আসে তুমি ওদের কিছু বলতে পার না? শিশুদের কুকুরকে ভাই ডাকার মনস্তত্ত্ব বুঝবো কি! আমার নিজেরই বলতে ইচ্ছে হল - কুকুর ভাই, জীবনের এই কঠিন পরীক্ষা থেকে তুমি আমাকেও একটু বাঁচাও।

0 comments:

Post a Comment