আমার এখনকার বরফ রাজ্যে নাম নেয়ার মত দুইটা নদী আছে, কোনটাই আমার না। আমার নদী ফেলে এসেছি অযুত মাইল পেছনে। তার কাছেই আমার রাজ্যের যত সুখ, তার কাছেই আমার এককালের সব চাওয়া ছিলো। তাকে ভালোবেসে দেড় বছর তাকে নিয়েই পড়েছিলাম। ইচ্ছা ছিলো আমার পিএইচডি গবেষণাটি হবে তাকে নিয়েই, দেড়টি বছর চষেও বেড়িয়েছি তার আঁকে-বাঁকে। তার মাছ, তার গাছ, তার পলি, তার পানি স্বপ্নেও দেখতাম। তারপর অন্যদিকের ডাকে আমার নদীটিকে ওখানেই শুইয়ে রেখে চলে গেলাম অন্যদেশে, অন্য কিছু গবেষণা করতে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে বিমান মাটি ছাড়তেই আমার নদীটি শুয়ে ছিলো চোখের সামনে, ক্যামেরা তাক করতেই থাই বিমানবালা মোলায়েম করে বলতে এলো, ছবি তোলা নিষেধ। 'মাই' শব্দটির ওপর দারুন জোর দিয়ে আমার মুখ ফস্কেই বেরিয়ে এলো, 'দিস ইজ মাই রিভার!!' বিমানবালা বিষ্ময়াহত অবস্থা থেকে ফিরে আসতে যে ক'টি মুহুর্ত দেরী করেছিলো, ঐটুকুই সময় দরকার ছিলো 'আমার নদী'র পোট্রেট নিতে।
বিমান থেকে নেয়া আমার ছবি
প্রায় একই দৃষ্টিকোণ থেকে গুগল আর্থের ছবি
নদীটির নাম কর্ণফুলী। মিজোরামের লুসাই পাহাড়ে তার জন্ম। তিনশ বিশ কিলোমিটার পথ এঁকেবেঁকে পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে পতেঙ্গায়। চট্টগ্রাম নগরী তারই কোল ঘেঁসে গড়ে ওঠা। এখানটায় নদীর প্রস্থ আটশ মিটার থেকে এক কিলোমিটার। মোহনার কাছে গভীরতা পূর্ণজোয়ারে ১৫-২০ মিটার। অমাবশ্যা পূর্ণিমায় জোয়ারভাটায় পানির উচ্চতার তারতম্য হয় সর্বোচ্চ সাড়ে ৫ মিটারের মত। বর্ষায় পানি প্রায় পুরোপুরি স্বাদু, লম্বা খরার মৌসুমে পানিতে শতকরা দুই থেকে আড়াইভাগ লবন থাকে, সে লবন-পানি পৌঁছায় কালুরঘাট পর্যন্ত। এল-নিনো নামের আবহাওয়া পরিবর্তনের বছরগুলোতে (যেমন, ১৯৯৭) লবনের খুব প্রাদুর্ভাব হয়, তখন লবন-পানি পৌঁছায় আরো অনেকদূর ভাটিতে, ঢুকে পড়ে হালদা নদীতেও। ভারী কলকারখানাগুলো বন্ধ হবার উপক্রম হয় মেশিন ঠান্ডা করার মিষ্ট পানির অভাবে। শহরবাসীর দূর্ভোগ হয় খাবার পানির। আমার নদী তাই শুধুই আমার নয়, পুরো চাটগাঁ বাসির।
কথিত আছে - "আরাকানের এক রাজকন্যা চট্টগ্রামের এক আদিবাসী রাজপুত্রের প্রেমে পড়েন। এক জ্যোৎস্না স্নাত রাতে তাঁরা দুই জন এই নদীতে নৌভ্রমণ উপভোগ করছিলেন। নদীর পানিতে চাঁদের প্রতিফলন দেখার সময় রাজকন্যার কানে গোঁজা একটি ফুল পানিতে পড়ে যায়। ফুলটি হারিয়ে কাতর রাজকন্যা সেটা উদ্ধারের জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু প্রবল স্রোতে রাজকন্যা ভেসে যান, তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায় নাই। রাজপুত্র রাজকন্যাকে বাঁচাতে পানিতে লাফ দেন, কিন্তু সফল হন নাই। রাজকন্যার শোকে রাজপুত্র পানিতে ডুবে আত্মাহুতি দেন। এই করুন কাহিনী থেকেই নদীটির নাম হয় কর্ণফুলী। মার্মা আদিবাসীদের কাছে নদীটির নাম কান্সা খিওং" (উইকিপিডিয়া)।
নজরুল তাই লিখেছিলেন-
ওগো ও কর্ণফুলী!
তোমার সলিলে পড়েছিল কার কানফুল খুলি?
তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী কে জানে
‘সাম্পান’ নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে?
আনমনে তার খুলে গেল খোঁপা, কান-ফুল গেল খুলি,
সে ফুল যতনে পরিয়া কানে হলে কি কর্ণফুলী?
দ্বিতীয় প্রজন্মের স্বর প্রযুক্তি
(হাবিবুর রহমান প্রজন্মের স্বর এখন আর আমার সংগ্রহে নেই)
Copyright 2010 সাইদুর রহমান চৌধুরী
Theme designed by Lorelei Web Design
Blogger Templates by Blogger Template Place | supported by One-4-All