ফোন তুলে হ্যালো বলতেই ওপাশ হতে, হাই সাইদ?
- স্পিকিং
- ম্ম্, আয় অ্যাম ক্রিস্টা
"হাই ক্রিস্টা" বলে প্রত্যুত্তর না দেবার জন্য নিজেকে খুব বোকা বোকা মনে হোল হঠাৎ, বুঝলাম কয়েকটি মূল্যবান পয়েন্ট হারিয়েছি ফোনালাপের সূচনাটি ঠিক ভাবে করতে না পেরে। আমতা আমতা করে বললাম, ও হ্যা, আমি বুঝতে পেরেছি, তোমার নাম্বার আমার ফোনবুকে আছে। বলেই বুঝলাম আরো বোকামী করে ফেলেছি।
- ইউ নিড আ রাইড?
- না, থ্যাংকস। আমি নিজেই চলে আসতে পারবো।
- দ্যাটস অঅঅঅসাম!! চলে আস তাহলে।
- কিন্তু এখনতো মাত্র তিনটা বাজে, আমার না পাঁচটায় আসবার কথা?
- হি হি হি, মানে হয়েছে কি, ব্রডির মা চলে এসেছেন, ভাবলাম তুমিও চলে আসলে মন্দ না।
- ঠিক আছে, তৈরী হয়ে আসতে যতক্ষণ লাগে।
- কান্ট ওয়েট। বাই!
জিপিএস দেশে ছেড়ে এসেছিলাম বলে গুগল ম্যাপে ক্রিস্টার বাড়ীর অবস্থান দেখে নিয়ে ২০ মিনিট পর যখন বেরুলাম বাইরে রীতিমত দুর্যোগ। দুশ মিলিমিটারের মত তুষারপাত হয়ে গিয়েছে, তখনো হয়েই চলেছে। একদিনে তিনশ-তে পৌঁছালে নাগরিক সব ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে, জরুরী অবস্থা জারী অবধারিত। পথঘাটের অবস্থা ভয়াবহ, তুষারপাত বন্ধ হবার আগে বরফ সরাবার গাড়িও নামবে না। উইন্টার টায়ার লাগানো হয়নি, তাই নেমে পড়ে খানিকটা করে হাওয়া ছেড়ে দিলাম।
সুখের কথা তার বাড়িটা খুব দুরে নয়, সাত কিলোমিটার; ভয়ের কথা আমাকে সবচেয়ে
ব্যস্ত রাস্তাটাই নিতে হবে। রেডিওতে জেনেছি গতরাত থেকে এ পর্যন্ত দুশ গাড়ী রাস্তা থেকে ছিটকে গিয়েছে নয়তো ঠোকাঠোকি হয়েছে। তবুও দমলাম না, যা হয় হবে। গাড়িটা এখন রাইট অফ হয়ে গেলে আমারই লাভ, ইন্সুরেন্সের ভাল টাকা হাতে পাওয়া যাবে। ইচ্ছে করে মেরে দিয়ে টাকা আদায়ের দিন শেষ, একমাত্র ভরসা এরকম ভরা দুর্যোগের দিন।
গুগল ম্যাপ স্ট্রীট ভিউ-তে ক্রিস্টার বাড়ি
দুর্যোগময় পথঘাট
গন্তব্যের কাছে
নব্বইয়ের পথ চল্লিশে, পঞ্চাশের পথ বিশে এরকম চালিয়ে যখন ক্রিস্টার এলাকায় পৌঁছালাম মানুষের বাড়ীঘরের আঙিনা কোনটা, ফুটপাথ (এদের ভাষায় কার্ব) কোনটা আর রাস্তা কোনটা আলাদা করে বোঝার কোন উপায় নেই। আক্ষরিক অর্থেই একরকম নৌকা বাইবার মত করে বরফের উপর পিছলে পিছলে ওর বাড়ির সামনে পৌঁছে ফোন দিলাম। বলে দেয়ায় বাড়িতে প্রবেশ করলাম পেছনের দরজা দিয়ে। সহাস্যে এমনভাবে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো ক্রিষ্টা যেমনটি করে থাকে আমাদের নিকটাত্মিয়েরা। বলা ভালো কিস্টার সাথে আমার সামাজিক মেলামেশা এটাই প্রথম নয়। কারণটাও সে নিজেই, সহজেই বন্ধু হয়ে যাবার বিরল ক্ষমতা আছে মেয়েটির। তার সাথে আমার পরিচয় কানাডা আসারও আগে ফেসবুকে। আমার কি ধরনের পোষাক আশাক নিয়ে আসা উচিত তার একটা ধারণা ওর কাছ থেকেই পাই আমি। খুব কমজনই অপরিচিত কোন বিজাতিয়কে এভাবে আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে চায়। কৌতুক করে কেউ কেউ বলে থাকে, কিস্টা
বোকা কারণ সে ব্লন্ড। বোকা আখ্যা দিয়ে আমি তার বন্ধুত্বকে অপমান করতে পারি না, আমি তাকে মেরু অঞ্চলের ছোট্ট শহর থেকে আসা একটি সহজ সরল মেয়ে হিসাবেই দেখি, যে বন্ধুত্বের অনাবীল আনন্দ কি তা জানে।
ক্রিস্টার বাড়ী
যাক গে, পায়ের জুতো গায়ের জ্যাকেট ছাড়িয়ে দুধাপ উঠতেই সরাসরি রান্নাঘরে। দুজন ব্যস্ত মহিলা রান্না থামিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা করলেন, একজন ক্রিস্টার বয়ফ্রেন্ড ব্রডির মা অন্যজন দাদী। রান্নাঘর পেরিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হোল লিভিং রুমে (ড্রইং রুম)। ১৫/১৬ বছরের একজন গভীর মনোযোগে বড় টিভিতে এক্সবক্সে গেমিং করছিলো। কিস্টা জানালো, এক্সবক্সটি খ্রিসমাস উপলক্ষ্যেই উপহার পেয়েছে, আর যে খেলছে ও ব্রডির ছোটভাই। পরিচয় হতে একটু জড়সড় হয়ে জানতে চাইলো আমি খেলবো কিনা, বললাম, না, আমি আসলে গেমে অভ্যস্তও নই। ক্রিস্টা চলে গিয়েছিলো রান্নাঘরে, বোধহয় সাহায্য করতে, এক মিনিটের মাথায় হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসে বললো, আজকে আমাদের খাবারের কোন অভাব নেই, তোমার যা ভালো লাগে খেয়ো, এখনো তৈরী হয়নি সব, আপাতত স্ন্যাকস দিয়ে শুরু কর। বুঝলাম নিত্য পিজা বার্গার ছাইপাশ খেয়ে ওরাও অতিষ্ট, আজ তাই এত আনন্দ। ক্রিস্টার পিঠাপিঠি বড় ভাই রুমে এসেই দখল নিলো এক্সবক্সের, নিয়েই বোধহয় তার মনে হোল আমাকে খেলতে বলা উচিত। আমি সবিনয়ে না বলায় নিজেও রেখে দিলো। আলাপ জুড়বার চেষ্টায় বললো, আমি খুবই ক্ষুধার্ত, তুমি? বললাম, আমরা ডিনার আরো অনেক পরে করি, আমার কোন সমস্যা নেই, তোমার খিধে বেশি হলে স্ন্যাক্স নাওনা কেন? কিন্তু কথা এগোলো না, ক্রিস্টার মত মুখর নয় বোঝাই গেল।
বাঁচা গেল আবার ক্রিস্টা এসে পড়ায়। বললো, সাইদ, ওয়ানা হ্যাভ আ লুক অ্যারাউন্ড মাই হাউজ? বলা হয়নি বাড়িটি তারা কেবলই কিনেছে এই অক্টোবরে, জীবনের প্রথম নিজের বাড়ি। দেখাতে চাইবার ইচ্ছাটা খুবই স্বাভাবিক। বললাম, আই উড লাভ টু! একতলা দোতলায় শোবার ঘর, বাথ, ক্লজেট, কোথায় ছুটিতে যাবার সময় ব্রেন্ডা-র ছেড়ে যাওয়া বিড়াল দুটি দুস্টুমি করে, কোথায় বসে থাকতে তার খুব ভালো লাগে ঘুরে ঘুরে দেখা শেষ হলে আবার নিচে নামলাম।
ক্রিস্টার পছন্দের স্থান থেকে নেয়া বাইরের ছবি
ততক্ষণে হাতের ব্যস্ততা শেষ করে ব্রডিও এসেছে। ব্রডির সাথে এর আগে আমার একবার মাত্র দেখা হয়েছে গত জানুয়ারীতে, আমরা সবাই বৌলিং-এ গিয়েছিলাম। তখনকার আলাপের সূত্র ধরে জানতে চাইলাম, তার পড়াশোনা শেষ হয়েছে কিনা। আরো টুকিটাকি কথাবার্তা, কিন্তু কেউই ঠিক ক্রিস্টার মত নয়। আমাকে উপদ্রব মনে করছে তা নয়, কিন্তু মুখচোরা বলে কথাও এগোচ্ছে না। ভাগ্যিস তখনই ডাক পড়লো রান্নাঘরে, ডিনার ইজ রেডীইইই!!!! ব্রডির মায়ের কন্ঠ।
যতটুকু বুঝেছি, ইনি একজন মায়াবতী, হাসিখুশি, মিশুক মানুষ। আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রতিটি খাবারের সাথে - কম করে হলেও বিশ পদ। সবার শেষটি ছিলো ইউক্রেনিয়ান পেরোগী। টিফানীর ভাইয়ের ডিনারেও এই খাবারটি ছিলো, তাই জানতে চাইলাম এটি কোনভাবে খ্রিসমাসের অনুসঙ্গ কিনা। জানলাম খ্রিসমাস ডিনারের বিশেষ কোন খাবার নেই, তাঁদের পূর্বপুরুষেরা রাশিয়ান ছিলেন তাই কিছু খাবারের প্রচলন এখনো আছে।
সুখাদ্য দিয়ে ডিনার হোল আমারও ঈদের পর এই প্রথম। কেবল হট চিলি সসটি আমার চিয়ে নিতে হয়েছিলো। ডিনারের পর আবার সবাই এসে বসলাম লিভিংয়ে। এই প্রথম কিছু ছবি তোলার সুযোগ পেলাম। অনুমতি চাইতেই খুশি হয়ে সবাই ছবির পোজ দিতে তৈরী হয়ে গেলেন।
ব্রডির মা, দাদী ও ছোট ভাই
বড় ভাইয়ের সাথে ক্রিস্টা
এখনো ব্যস্ত ব্রডি
ক্রিস্টা ও আমি
ব্রডি ও ভাইয়ের সাথে ক্রিস্টা
সেমচুকদের সাথে আমি
ছবি তোলার পর সদ্য পাওয়া ট্রিভিয়া গেমের বাক্সটি খোলা হোল। সবাই মিলে দুঘন্টার মত খেলা হোল, তার মাঝে হাসি ঠাট্টা হালকা চালে গল্পগুজব। বোঝা গেল আরো অনেকক্ষণ চলবে এই গেম। বাইরে আবার দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পেরে যাবার অনুমতি চাইলাম। মিলতেই উঠে পড়লাম। ব্রডির মা আমার হাতে দুবাক্স চকোলেট তুলে দিয়ে লজ্জিত হয়ে বললেন, তোমার নামটা বড্ড দেরীতে জেনেছি। দেখলাম ছোট্ট একটি কার্ডে বাক্সের ওপর লেখা আছে -
"To
Our new friend
From
Semchuks"
বেরুবার পথে ক্রিস্টা আর ব্রেন্ডার একটি বিড়াল আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে ভুলেনি।
ট্রিভিয়া গেম
দুর্যোগের রাত
Copyright 2010 সাইদুর রহমান চৌধুরী
Theme designed by Lorelei Web Design
Blogger Templates by Blogger Template Place | supported by One-4-All
0 comments:
Post a Comment