পূর্বসূত্রঃ প্রথম দেখা খ্রিসমাসের খুটিনাটি
প্রার্থনা হল থেকে বেরুতেই দেখি পুরোদস্তুর ঈদ। সবাই কোলাকোলির মত করে হাগ করছে একে অন্যকে, কুশলাদী বিনিময় চলছে। বাচ্চারা সার বেধে হলওয়ের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে, যেই সামনে পড়ছে তাকেই তোতাপাখির মত বলে যাচ্ছে 'মেরী খ্রিসমাস', 'মেরী খ্রিসমাস'। বাদামী ছোটখাট একজন মানুষ হিসাবে আমার প্রতি কৌতুহলটা তাদের কম নয়, ইতস্তত করে হলেও আমাকেও দুএকজন বললো। বড়রা অনেকেই এগিয়ে এল হ্যান্ডশেক করে 'মেরী খ্রিসমাস' জানানোর জন্য। টিফানীর দৃষ্টি লক্ষ্য করে দ্রুত এ পর্ব শেষ করে নিজের জ্যাকেটটি সংগ্রহ করে বেরিয়ে পড়লাম গির্জা থেকে।
আবার চড়লাম গাড়ীতে। টিফানীর মা-বাবা চললেন তাদের গাড়িতে। চলতে শুরু করতেই জানতে চাইলাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি। টিফানীর নানীর শুধু দুই মেয়ে - তার মা আর খালা। নানী মারা যাবার পর তার ছোট ছোট দুটি খামারের উত্তরাধিকার পায় দুই মেয়ে। তার মায়ের ভাগের খামারটি এখন দেখাশোনা করে টিফানীর ছোট ভাই কার্ট। শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দুরে। কার্ট ওখানেই থাকে খামার বাড়িতে। গত কয়েকবছর ধরে ওরা ট্র্যাডিশান করে নিয়েছে ২৪ ডিসেম্বরের ডিনারটি হবে কার্টের ওখানে আর ২৫ এর টা মা-বাবার শহরের বাড়িতে। সেমতই চলেছি খামারের পথে। শহর ছাড়িয়ে কাঁকরের রাস্তা, যদিও বরফে ঢাকা পড়ে আছে। এই ধরে ছয় কিলোমিটার। ততক্ষণে গাঢ় অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক। গ্রাম্য রাস্তা বলে কোন সড়ক বাতি নেই, তীব্র ঠান্ডায় ডাকার মত নেই ঝিঝি বা অন্য কোন পোকা, বরফঢাকা বলে গাড়ির চাকায় কাঁকর ছড়কে যাবারও শব্দ নেই। পেছনে দুরে শহরের বাতি ছাড়া আর যেদিকেই দৃষ্টি যায় আলোর কোন চিহ্নই নেই, বরফে প্রায় বুঁজে আসা গাড়ির হেডলাইটের আলো আর ড্যাশবোর্ডের নরম সবুজ আভা ছাড়া। এরকম অসম্ভব নিঃস্তব্ধতা আমার কল্পনাতেই কখনো কখনো দেখেছি শুধু। এই উচ্চকিত নিরবতা উপভোগ করতে গিয়ে আমি হয়তো এ জগতেই ছিলামই না, সম্বিত ফিরলো টিফানীর খলখল হাসিতে, "আই নো হোয়াট ইউ আর থিংকিং। ইটস কাইন্ড অব মিডল অব নো-হোয়্যার, ইফ ইউ উড" (জানি কি ভাবছ, এ কোন অচিনপুরে তোমাকে নিয়ে এলাম! যদি সেরকম বলতেই চাও")। সত্যি অচিনপুর!
অবশেষে শেষ হোল অচিনপুরের যাত্রা। গাড়ি থেকে নেমেই ঝটপট দুয়েকটা ছবি তুললাম। আরো তোলার ইচ্ছা ছিল সময় নিয়ে, কিন্তু ছবি তুলতে দস্তানা খুলতে হয়, এত ঠান্ডায় দস্তানা ছাড়া ২/৩ মিনিটের বেশি থাকাও দায়।
তাই ঢুকে পড়লাম ঘরে। সুন্দর ছিমছাম ছোট্ট একটা বাড়ী। কার্ট ভীষন ব্যস্ত তার ল্যাম্ব গ্রীল আর গার্লিক বান তৈরীতে। একটু করে এসে কুশল বিনিময় শেষে জানতে চাইল কি ড্রিংক আমার পছন্দ - ওয়াইন, স্কচ, ভদকা, বিয়ার? চাইলাম কোমল কিছু, একরকম অবিশ্বাসের সাথে আমাকে দেয়া হলো ক্র্যানবেরী মিক্সড জুস। টিফানী অবশ্য খুবই খুশি হল, প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, সাইদ খুব ভালো হলো, আমি তাহলে একটু বেশিই পান করতে পারি। তুমি সোবার (মাতাল নয়) থাকলে আমার ডেজিগনেটেড ড্রাইভার হতে তোমার নিশ্চয়ই আপত্তি নেই। বললাম, না নেই, উইনিপেগ পৌঁছে দিতে পারব, তবে সিড়ি বয়ে ঘরে পৌছে দিতে পারব না।
আমি নিয়ে গিয়েছিলাম দুই বাক্স প্রিমিয়াম চকোলেট, তারা স্থান করে নিল খ্রিসমাস ট্রী-র নিচে অন্যান্য উপহার সামগ্রীর সাথে। একে একে যাদের আসার কথা সবাই এলো। সবাই বলতে টিফানীর মা, বাবা, খালা, খালার তিন মেয়ে, তাদের একজনের স্বামী, আর মায়ের এক বান্ধবী। জমে উঠলো জম্পেশ আড্ডা। আমার সত্যি এতদিন ধারণা ছিল এরা আড্ডা কি জিনিস জানেই না, ভুল ভাংলো সেই সন্ধ্যায়। ঠিক আমরা যেমন করে আড্ডা দেই, তেমনি আড্ডা। বরং তারচেয়েও এককাঠি সরস, কারণ এই আড্ডায় ক্ষণে ক্ষণেই চলে আসে প্রাপ্তবয়স্ক বিষয় আশয়। বাংলাদেশ নিয়ে অনেক কৌতুহল ওদের, যা যা জানতে চাইল সব জানালাম। আমরা ছাগলের দুধ খাই কিনা, ঈদে কি কি করি, বাংলাদেশে গির্জা আছে কিনা, বিয়ের আগে একসাথে থাকিনা কেন, শুকরের মাংস কেন খাইনা, কানাডার কোন জিনিসটি দেখে শিক্ষা বা অভিবাসনের জন্য আমরা আসি, বিয়ের বাইরেও একটু "উকিঝুকি" মারি কিনা, যদি মারি ধরা পড়লে পরিনাম কি - এই রকমের হাজার প্রশ্ন। প্রসঙ্গান্তরে আড্ডা চললো মুভি, স্পোর্টস, বাংলাদেশ ও কানাডার রাজনীতি, কানাডার অয়েল ইন্ডাষ্ট্রী, ১৯৯৭ ও ২০০৮ এর ভয়াবহ বন্যা, অবধারিতভাবে কিছু বুশ ও হার্পার জোক (হার্পার কানাডার প্রধানমন্ত্রী, 'ডাম্বেস্ট এভার' হিসাবে পরিচিত), খাবার-দাবার, ১৮+ জোকস, ম্যানিটোবার উইন্টার, ব্যক্তিগত জীবন - কি নয়?
টিফানী ও আমি
টিফানীর বাবা ও মায়ের বান্ধবী
মা ও খালা
বোন ও ভগ্নিপতি (অন্যজনের)
আড্ডা চলছে
চলছেই
কার্টের রান্নাবান্না
এরমধ্যে বান বেক করতে গিয়ে কার্ট আগুন ধরিয়ে ফেললো আভেনে। নুতন জিনিস শিখলাম - লবন ছিটিয়ে দিতেই নিভে গেল আগুন। কিন্তু বান ততক্ষণে পুড়ে ছাই। অগত্যা নুতন করে বেকিং করতে হবে। তাই সবাই বললো মিউজিক হোক। পিয়ানোর সাথে গাইলো টিফানীর দুই খালাত বোন।
একসময় খাবার তৈরী হোল। খুব সাধরণ মেনু - গ্রীলড ল্যাম্ব, গার্লিক বান, ইউক্রেইনিয়ান পেরোগী (অনেকটা নেপালী মোমো-র মত), সালাদ, আর সেদ্ধ গাজর। তবে খেতে খারাপ লাগলো না, আসলে খাবারের চেয়েও গল্পগুজবই ছিলো প্রধান। খাবারের ছবি তোলা ভালো দেখায়না বলে তুললাম না। লম্বা কাহিনী ছোট করে বললে, এরপর যাবার সময় এলো। একে একে বিদায় নিল সবাই। রইলাম টিফানীরা চারজন আর আমি। ওরা চারজন সবাই সবাইকে খ্রিসমাস কার্ড দিলো, সাথে একটি করে বিশাল বড় চিঠি। জানিনা চিঠিতে কি রয়েছে। আমাকে অবাক বসিয়ে রেখে চারজনই বসে গেল চিঠি পড়তে। চিঠির পর উপহার দেয়ার পালা, খ্রিসমাস ট্রীর নিচ থেকে নিয়ে সবাই সবাইকে উপহার বিতরণ করলো (আগেই প্রাপকের নাম লেখা ছিল)। দেখলাম আমার নামেও দুটি বাক্স - টিফানীর মায়ের তরফ থেকে। সেখানেই সবার উপহার সামগ্রী খোলা হোল - আমার এক বাক্সে পাওয়া গেল পাঁচটি গানের সিডি, অন্য বাক্সে একটি সুয়েটার আর একজোড়া পশমী মিট (আঙ্গুল ছাড়া দস্তানা)। চকলেট ছাড়া আর কিছু নেইনি বলে লজ্জাই লাগলো।
রাত ১১:১৫। রওনা হলাম উইনিপেগের উদ্দেশ্যে। ঠিক বারোটায় আমার অ্যাপার্টমেন্টে নামার সময় স্টীয়ারিং টিফানীর হাতে দিয়ে বললাম, মেরী খ্রিসমাস অ্যান্ড গুড নাইট। ওপাশ থেকেও একই জবাবই হয়েতো এসেছে, শোনার অপেক্ষা না করেই ঢুকে পড়লাম নিজের ডেরায়।
Copyright 2010 সাইদুর রহমান চৌধুরী
Theme designed by Lorelei Web Design
Blogger Templates by Blogger Template Place | supported by One-4-All
0 comments:
Post a Comment