[থাইল্যান্ডে (সায়াম বা শ্যামদেশ) আমার দিনযাপনের টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো একদিন হয়তো মলিন বিবর্ণ হয়ে যাবে, এখনই অনেকটা হয়েছে। যেটুকু স্মৃতিতে আছে তার কিছুটা তুলে রাখতে চাই 'শ্যামরাজ্যের গল্প' হিসেবে ছোট ছোট পর্বে। ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় নয়, যখন যা মনে পড়ে তাই লিখবার ইচ্ছে। আমার ছেলে-মেয়ের প্রায় কিছুই আর মনে পড়েনা, আর কারো না হোক একদিন তাদেরই হয়তো গল্পগুলো পড়তে ভালো লাগবে, মনে করার চেষ্টা করবে অতিশৈশবের দিনগুলো]
আগের পর্বঃ
২. শ্যামরাজ্যের গল্পঃ কুকুর ভাই পর্ব
১. শ্যামরাজ্যের গল্পঃ সার্ভাইভাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাক
প্রথমার্ধের পর
২৪ তারিখ সকালে প্রাসাদের উদ্যেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হোল কয়েকটি ভ্যান (মাইক্রোবাস) বোঝাই করে। প্রথমেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হোল তাদের শিক্ষাবিষয়ক কোন এক দপ্তরে। সেখানে চুড়ান্ত দফা মহড়া। মহড়া দেখে শিক্ষা বিভাগের মন্ত্রী-সচিব পর্যায়ের কর্মকতারা সন্তুষ্ট হবার পর প্রাসাদে যাবার ছাড়পত্র দেয়া হোল। আবার স্বল্প দুরত্বের পথ শেষ করে অবশেষে পৌঁছালাম চিত্রালদা প্যালেসে। সে এক এলাহী ব্যাপার, চার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রাসাদ কমপ্লেক্স, ছোটখাট একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নগরীর মতো। এ রাস্তা সে রাস্তা ঘুরে ভ্যানগুলো আমাদের নিয়ে পৌঁছালো দরবার হল (ওদের নামানুসারে কী জানা হয়নি) গেটে। এখানেই আমাদের সনদ প্রদান করবেন রাজকুমারী সিরিনধর্ণ, অফিশিয়ালি বলা হয়েছে রয়্যাল অডিয়েন্স বা রাজদর্শণ দান – এ কারণেই পর্বটির নাম এভাবে দিলাম।
অতীতে অনেক রাজাই সিংহাসনে বসার পর পুরনো রাজার প্রাসাদে বাস না করে নিজের জন্য নুতন প্রাসাদ বানিয়েছেন। আবার কোন কোন রাজা অবকাশ যাপনের জন্য বানিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রাসাদ। এ কারণে থাইল্যান্ডে বেশ কটি রাজপ্রাসাদ আছে যেগুলোতে এখন আর রাজোত্তরাধীকারীদের কেউ বসবাস করে না। এগুলো খুলে দেয়া হয়েছে পর্যটকদের জন্য। সেরকম চারটি প্রাসাদে আমি গিয়েছি, যার দুটোতে প্রবেশের আগে জুতা খুলতে হয়েছে। চিত্রালদা প্যালেস হোল লিভিং প্যালেস – এখানে রাজপরিবার বসবাস করে, তাই দরবার হলে ঢুকার আগে প্রমাদ গুনছিলাম – না জানি কি খুলতে বলে! অবাকই হলাম এখানে কিছুই খুলতে হয়নি, শুধু প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পরীক্ষা করা হয়েছে সবাইকে।
ঢুকেই দেখলাম দরবার হলকে একটি হালকা পার্টিশান দিয়ে দুভাগ করা হয়েছে সাময়িক ভাবে – ঢুকতেই অভ্যর্থনা অংশ আর ভেতরে মূল রাজদর্শণের আয়োজন। কয়েক রকমের সুপেয় পানীয় দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন রাজকর্মীরা। তারপরই নিয়ে যাওয়া হোল ভেতরের অংশে। সেখানে দুসারিতে চেয়ার পাতা হয়েছে – এক সারিতে আমরা ২৪ জন, অন্য সারিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও অনুষ্ঠানের অভ্যাগতরা। কিছুক্ষণ পরেই হলে প্রবেশ করে রাজকুমারী তাঁর আসন নিলেন। থাইল্যান্ডের সরকারী টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষের ফোন কার্ডে যে সুন্দরী সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ রাজকণ্যার ছবি এতদিন দেখে এসেছি, তার সাথে এই পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই রাজকুমারীকে মেলাতে না পেরে মনে মনে হতাশই হলাম। রাজকণ্যাদের হাতে অনেক কাজ, তাই পৌঁছা মাত্রই সনদ বিতরণের কাজ শুরু। একে একে আমাদের নাম ডাকা হোল আর আমরা মহড়া মোতাবেক গিয়ে সনদ গ্রহণ করে ফিরে এলাম নিজের আসনে। আমার শুধু একটাই ভয় হচ্ছিলো, আমি যে ‘মুসলিম পুরুষ’ এই সংবাদটি রাজকুমারীকে বা নিরাপত্তা কর্মীদের সঠিক ভাবে জানানো হয়েছে কিনা, যদি না হয় তাহলে দেখা যাবে দাঁড়িয়ে সনদ নেয়ার অপরাধে আমাকে না জানি কি করা হয়! সর্বনিম্ন শাস্তি নিশ্চিত দেশ থেকে বহিস্কার! নাহ, সেরকম কিছু হয়নি, সসম্মানে দাঁড়িয়েই সনদ নিতে পারলাম।
সনদ বিতরণের পর আবার ফিরিয়ে আনা হোল অভ্যর্থনা কক্ষে, সেখানে রাজপ্রাসাদের খামারে উৎপাদিত জিঞ্জার বিয়ারের একটা করে বোতল দেয়া হোল সাথে নিয়ে যাবার জন্য – বোতলের গায়ে রয়্যাল ইনস্ক্রিপশন (রাজকীয় সীলমোহর)। আমরা যারা বিদেশী তাদের উদ্যেশ্যে এক কর্মকর্তা বললেন, তোমরা হয়তো পানীয়টি পান করে বোতলটি ফেলে দেবে, কিন্তু আমরা নিশ্চিত থাইয়েরা এই বোতলটিই তাদের নাতীদের দেখাবার জন্য রেখে দেবে কয়েকযুগ। সত্যিই আমার বোতলটি আমি ফেলে দিয়েছি কোথায় তাই মনে নেই।
সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে এলাম আবার ক্যাম্পাসে – পৌঁছাতেই যে বিষ্ময় অপেক্ষা করছিলো তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। পর পর দুজন পরিচিত সেক্রেটারী রাস্তায় দেখা হতেই বললো, তোমাকে তো টিভিতে দেখেছি! তখনই জানলাম, যে ক্যামেরাগুলো দরবার হলে চলতে দেখেছিলাম ওগুলো আমাদের অনুষ্ঠানটি লাইভ টেলিকাস্ট করার কাজে ব্যস্ত ছিলো।
শেষকথাঃ ঝাড়া দুমাস পর আমার ঠিকানায় একটি খাম এলো – ভেতরে আমার সনদ গ্রহণের একটি ছবি, ছবির পেছনে রাজকীয় সীলমোহর দেয়া। ছবিটি নিচে দিলাম।
(রাজদর্শণ পর্ব সমাপ্ত)
যে দুরত্বে দাঁড়িয়ে উপবিষ্ট কারো কাছ থেকে সনদ গ্রহণ করেছি তাতে এটুকু না ঝুঁকে কোন উপায় ছিলো? :P
Copyright 2010 সাইদুর রহমান চৌধুরী
Theme designed by Lorelei Web Design
Blogger Templates by Blogger Template Place | supported by One-4-All
0 comments:
Post a Comment