পুরনো পর্বঃ
শক্ড অ্যাব্রোড - ০১ | শক্ড অ্যাব্রোড - ০২
প্রথম পর্বের ভুমিকাঃ
জুন ১৯৯৪। জীবনের প্রথম দেশের বাইরে ভ্রমন। বয়স ও অভিজ্ঞতা দুটোই অনেক কম। এখনকার মত চাইলেই দেশ-বিদেশের হাল হাকিকত জানা অত সহজ ছিলো না। যদিও আমার ইন্টারনেট ছিলো, কিন্তু তার জন্য আমাকে প্রথম দিকে হংকং, পরে ঢাকার আইএসপি-কে ডায়াল করতে হোত প্রতি মিনিট যদ্দুর মনে পড়ে যথাক্রমে ৬৫ ও ৪০ টাকা ফোনের বিল খরচ করে। তাই ই-মেল ছাড়া অন্য কাজে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রশ্নই ওঠে না। সে রকম একটি সময়ে বিদেশ যাওয়া মানেই অনেকগুলো ধাক্কা খাওয়ার মত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হওয়া। তারই কয়েকটি সংক্ষেপে বলি।
এ পর্বের ভুমিকাঃ
সিঙ্গাপুর থেকে দৃষ্টি ফেরাই একটু থাইল্যান্ডের দিকে। থাইল্যান্ড দেশটি সিঙ্গাপুরের মত ধনী নয়, উন্নত নয়, শিক্ষিতও নয়। পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে বাংলাদেশ যেমন একটি উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশ, থাইল্যান্ডও তাই। এর মধ্যে আমারও বয়স বেড়েছে, সাথে কিছু অভিজ্ঞতাও। কাজেই তুচ্ছ জিনিস দেখে ধাক্কা খাওয়ার বোধটা অনেকটা কমেছে। তবু কি ধাক্কা না খেয়ে পারি, তাও থাইল্যান্ডের মত 'অল্পশিক্ষিত' 'দরিদ্র' 'উন্নয়নশীল' দেশে এসব দেখার পর? এ পর্বের ধাক্কাগুলো সবই খেয়েছি নগর পরিবহনের বাসে।
শক # ৭
নগর পরিবহনের বাসে একদল কালো স্কার্ট সাদা শার্ট পরা মেয়েকে দেখে ছুটির পর বাড়ি ফেরা স্কুল ছাত্রীই ভেবেছিলাম। ভিড়ের বাসে আমার মুখোমুখি দাঁড়ানো মেয়েটির শার্টে লাগানো ছোট ব্যাজ পিনটিতে দেখি লেখা রয়েছে 'চুলালংকর্ণ ইউনিভার্সিটি'। খেয়াল করে দেখলাম সবার সার্টেই একই পিন লাগানো। এবার ছেলেগুলোকেও দেখলাম - সাদা শার্ট, একই ব্যাজপিন। সেদিনই খোঁজ নিয়ে জানলাম প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্র্যাড পর্যন্ত ইউনিফর্ম বাধ্যতামূলক, শুধু গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের (মাস্টার্স, পিএইডি) ইউনিফর্ম নেই। মনে পড়ে গেল প্রায় বিশ বছর আগে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকার সময় আমরা কলেজের ব্যাজ পরার প্রস্তাবটি গুজব থাকা অবস্থায়ই আন্দোলন করে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। আর এখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের ছাত্র-ছাত্রীকেও এত অনুশাসনে রাখা সম্ভব? কি আজব দেশ!
শক # ৮
স্কুল ও অফিস ছুটির সময় ঢাকার মতই উপচে পড়া ভিড় প্রতিটা বাসে, তফাত বলতে শুধু ওদের বাসগুলো ভেতরে বাইরে আমাদেরগুলোর চেয়ে কিছুটা চকচকা ঝকঝকা। কিছুক্ষণ চলার পর টের পেলাম আসল তফাতটি। যারা বসতে পেরেছে তাদের কেউ বই খুলে পড়তে বসে গেছে, কেউ ক্রসওয়র্ড পাজল বা সুডোকু মেলাতে ব্যস্ত, কারো কানে হেডফোন লাগানো, বাকিরা হয় ঝিমুচ্ছে, নয় বাইরে তাকিয়ে। বেশির ভাগই অবস্থাপন্ন নয়, পোশাকেই বোঝা যায় সাধারণ শ্রমিক বা কর্মজীবি, কেউ কেউ পেট্রল পাম্পের বা কনভেনিয়েন্স স্টোরের ইউনিফর্মটি তখনো পরিহিত। দুচার জন পাওয়া যাবেই মোবাইল ফোনে কথা বলছে। কিন্তু সত্তর-আশি জন যাত্রি নিয়ে চলা ভিড়ের বাসটিতে ইঞ্জিনের গুঞ্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই কেন? হুড়োহুড়ি গুতোগুতি হইচই চিৎকার নেই কেন? ফোনে যে কথা বলছে সে ফিসফাস করে কথা বলছে কেন? চিৎকার করে কেন পুরো বাসের সবাইকে তার হাঁড়ির খবর জানাচ্ছে না? সহপাঠি যারা একসাথে উঠেছে তারা কেন তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে কোরাস গেয়ে অন্যদের কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে না? কি আজব দেশ!!
শক # ৯
ভিড়ের বাসেই আবার। এদিনের ভিড়টি অন্যরকম, উইকএন্ডের। ব্যাংকক থেকে আমার কনফারেন্স ভেন্যুতে ফিরছি। ট্রাফিক জ্যামের অবস্থা বুঝে পয়তাল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘন্টা লাগতে পারে। যথারীতি কোন সীট খালি নেই, দাঁড়িয়ে আছি মাঝখানের একটা পোল ধরে। মিনিট দশেক চলার পর ভিড়ের ভেতর একটা নড়াচড়া টের পেলাম আমার পাশেই। তাকিয়ে দেখি পাশের সীটের একজন উঠে দাঁড়াবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি প্রমাদ গুনলাম - এই বুঝি একটা হুড়োহুড়ি লেগে যায় আশপাশের দাঁড়ানোদের মধ্যে, কার আগে কে বসবে তা নিয়ে। সীটটি আমারও নাগালের ভেতরেই, কিন্তু বিদেশী হিসেবে স্থানীয়দের সাথে হুড়োহুড়ি করতে যাওয়া কতটা ভালো হবে বুঝতে না পেরে শক্ত করে পোলটিই আঁকড়ে ধরলাম, ধাক্কাধাক্কি হলে যেন সামাল দিতে পারি ভেবে। সীটের মানুষটি উঠে দাঁড়ালো, সবাই তাকে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য পথও করে দিলো যতটুকু পারা যায়, কিন্তু কয়েকমুহুর্ত সীটটি খালিই পড়ে রইল। পাশে দাঁড়ানোরা এ ওর মুখের দিকে চায়, কেউ বসেনা। পরে জেনেছি এভাবেই ওরা বোঝার চেষ্টা করে কার প্রয়োজনটা বেশি। কি আজব দেশ!!!
Copyright 2010 সাইদুর রহমান চৌধুরী
Theme designed by Lorelei Web Design
Blogger Templates by Blogger Template Place | supported by One-4-All
0 comments:
Post a Comment