Written by Sayedur R Chowdhury
Posted in:
স্মৃতি
[থাইল্যান্ডে (সায়াম বা শ্যামদেশ) আমার দিনযাপনের টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো একদিন হয়তো মলিন বিবর্ণ হয়ে যাবে, এখনই অনেকটা হয়েছে। যেটুকু স্মৃতিতে আছে তার কিছুটা তুলে রাখতে চাই 'শ্যামরাজ্যের গল্প' হিসেবে ছোট ছোট পর্বে। ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় নয়, যখন যা মনে পড়ে তাই লিখবার ইচ্ছে। আমার ছেলে-মেয়ের প্রায় কিছুই আর মনে পড়েনা, আর কারো না হোক একদিন তাদেরই হয়তো গল্পগুলো পড়তে ভালো লাগবে, মনে করার চেষ্টা করবে অতিশৈশবের দিনগুলো]
আগের পর্বঃ
২.
শ্যামরাজ্যের গল্পঃ কুকুর ভাই পর্ব
১.
শ্যামরাজ্যের গল্পঃ সার্ভাইভাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাক
১৯৩৭-৩৮ সনের দিকে আমার বাবা একবার ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপ্রাসাদে মহারাজার সাথে ভোজে মিলিত হয়েছিলেন মহারানা কাপ ফুটবলের সোনাজয়ী দলের ফরোয়ার্ড হিসাবে। ত্রিপুরা তখনো রাজাশাসিত রাজ্যই, বৃটিশদের একটু খবরদারী থাকলেও পুরোপুরি বৃটিশ উপনিবেশের অংশ নয়। বাবার কাছে গল্প শুনে নিজের চোখে রাজা-রাজপ্রাসাদ দেখার খুব ইচ্ছে হোত। আমার বাবার রাজদর্শণ লাভের কয়েকবছরের মধ্যেই হাজারখানেক মাইল দুরে শ্যামরাজ্যের নুতন রাজা ভূমিবল আদুলায়েজে সিংহাসনে বসলেন নাবালক রাজা হিসাবে। সেই যে তিনি বসলেন, আজও আছেন। পৃথিবীর লিখিত ইতিহাসে দীর্ঘতম সময়ের জন্য রাজা থাকার রেকর্ডটি রাজা ভূমিবলের। এই রাজার দীর্ঘ প্রায় ৬৫ বছরের রাজতান্ত্রিক রাজত্বে অবশ্য পরিবর্তন হয়ে এখন দেশটি রাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের যুগে প্রবেশ করেছে। তবু থাইল্যান্ডের সাধারণ মানুষের কাছে এখনো রাজা ভূমিবল পুরোদমেই রাজা।
আমার বাবার রাজদর্শণের প্রায় ৬৫ বছর পর আমি সুযোগ পেলাম থাইল্যান্ডের রাজপ্রাসাদে রাজকণ্যার দর্শন লাভে। রাজকণ্যা মহাচাক্রি সিরিনধর্ণ রাজা ভূমিবলের দ্বিতীয়া কণ্যা, হার রয়্যাল হাইনেস। থাই ভাষায় তাঁর উপাধি ফ্রা থেপ (প্রিন্সেস অ্যাঞ্জেল)। রাজার পর রাজপরিবারের সবচেয়ে জনপ্রিয় সদস্য, সাধারণ মানুষের আকাংখা রাজার মৃত্যুর পর তিনিই যেন হন সিংহাসনের অধিপতি, যদিও ভাইয়ের কারণে তা হবার নয়। যাক সে কথা, আমি থাইল্যান্ডে গিয়েছিলাম রাজারই অর্থানুকূল্যে পড়াশোনা করার জন্য। সে বছর আমি ছাড়াও বিভিন্ন দেশের আরো পনেরো জন কিংস স্কলারশিপ লাভ করি, নয় জন লাভ করেন কুইন্স স্কলারশীপ। ঠিক হোল এই চব্বিশ জনকে চব্বিশে অক্টোবরে কিংস স্কলার ও কুইন্স স্কলার হিসাবে সনদ দেয়া হবে রাজার বর্তমান নিবাস চিত্রালদা প্যালেসে, আর রাজা-রাণীর হয়ে কাজটি করবেন রাজকণ্যা "সমদেত ফ্রা থেপ্রাত রাতসুদা চাও ফা মহা চাক্রি সিরিনধর্ণ রাত্তাসিমা খুনকন পিয়াচাত সায়াম বোরোমারাতচা কুমারী" (এটিই তাঁর অফিসিয়াল উপাধী)।
সে এক মহা যজ্ঞ! শুরু হোল আমাদের সনদ নেয়ার মহড়া। রাজাপ্রসাদের কর্মকর্তা, শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা এলেন আমাদের ক্যাম্পাসে আমাদের শিখিয়ে পড়িয়ে ট্রেনিং দিয়ে তৈরী করে নিতে। একজন রাজকণ্যার ভূমিকায় নামলেন আর শিখিয়ে দেয়া পদ্ধতিতে আমরা নাম ঘোষণার পর একে একে সনদ গ্রহণ করার মহড়া দিতে লাগলাম। কি করে আসন ছাড়তে হবে, কি করে হাটতে হবে, রাজকণ্যার চোখে সরাসরি না তাকানো, কি করে সনদ গ্রহন করতে হবে, সনদ গ্রহণ করে পিছু হেটে আবার নিজের আসনে ফিরে আসা - একেবারে চুলচেরা মহড়া। জানিয়ে দেয়া হোল কিছুতেই সনদ গ্রহণের এই অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকা যাবেনা। একজন সাহস করে জানতে চাইলো, যদি অসুস্থ থাকি? বলা হোল, এই অনুষ্ঠান বর্জন করার দুটি মাত্র অজুহাত গ্রহণযোগ্য - চিরদিনের জন্য থাইল্যান্ড ত্যাগ অথবা মৃত্যু। অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্সে করে নেয়া হবে (পরে অবশ্য বলে দেয়া হয়েছে ওটা ছিলো জোক)। যে ২-৩ জন থাই নাগরিক ছিলো তাদের বার বার করে বলে দেয়া হোল তারা যেন সনদ নিতে গিয়ে আনন্দের আতিশয্যে অজ্ঞান না হয়ে যায়।
সনদ গ্রহন করার প্রক্রিয়াটি ছিলো আমাদের মানসিকতায় খুবই অপমানজনক। রাজকণ্যার সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে হাটু গেড়ে বসতে হবে, তারপর সনদটি হাতে দেয়া হলে ধীর পায়ে উঠে ফিরে আসতে হবে। আমাকে, শুধুই আমাকে, বলা হোল তোমাকে হাটু গেড়ে মাথা নিচু করতে হবে না, কারন আমরা জেনেছি তুমি মুসলিম। কুইন্স স্কলার বাংলাদেশী মেয়ে ফারজানা যুঁথী সাথে সাথে বললো, আমিও মুসলিম। তাকে জানানো হোল, কিন্তু তুমিতো নারী, এই ব্যতিক্রম শুধুই মুসলিম পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমি জানালাম, এখানে নারী বা পুরুষের ভেদ নেই, একজন মুসলিম পুরুষ যে কারণে অন্যের সামনে মাথা ঝুঁকায় না, একজন নারীও একই কারণেই তা করতে পারে না। তারা বললো, কিছুই করার নেই, নুতন করে রয়্যাল ডিক্রি জারী না হওয়া পর্যন্ত যা নিয়ম আছে তাই পালন করতে হবে। বলে দেয়া হোল, তবুতো তোমরা অতি ভাগ্যবান, রাজকণ্যার হাত থেকে সরাসরি সনদ নেবে, মাঝখানে তৃতীয় কোন বস্তুর সাহায্য ছাড়াই। এই সৌভাগ্য খুব বেশি থাই নাগরিকেরও সারা জীবনে হয়নি। উল্লেখ্য, রাজপরিবারের সদস্যের হাত থেকে কিছু নেয়ার সময় সাধারনত ৩য় বস্তু হিসাবে একটি সোনালী ধারণ পাত্র হাতে ধরে রাখতে হয়, তার উপর প্রদেয় জিনিসটি দেয়া হয়।
(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)
সচরাচর যে পদ্ধতিতে রাজকীয় দান গ্রহণ করতে হয়
0 comments:
Post a Comment