যেখানেই যাই, যে বিমানবন্দরই হোক কোন সাহায্যকারী ছাড়াই মোটামোটি শংকাহীন সব কিছু সমাধা করি। যতক্ষণ আমার কাগজপত্র ঠিক আছে এবং যতক্ষন আমি কোন ঝামেলার সাথে যুক্ত নই ততক্ষন ভীত হওয়ারও কিছু নেই। বেশিরভাগ সময়েই চেষ্টা করি আমার যা অ্যালাওয়েন্স তার ভেতরে থাকতে, যাতে বিমানবন্দরগুলোয় কাউকে কোন অন্যায্য অনুরোধও করতে না হয় - মাথা উঁচু করে বুক টানটান করেই যেন চলতে পারি। চলিও তাই, আত্মবিশ্বাস নিয়েই। কিন্তু সব আত্মবিশ্বাস ঝুর ঝুর করে ভেঙ্গে পড়ে যখন ঢাকা বিমানবন্দর ব্যবহার করার সময় আসে। এখানে কাগজ ঠিক থাকলেও, অ্যালাওয়েন্সের মধ্যে থাকলেও প্রতিক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি আমার কোন খুঁতের কারণে কোন কর্তৃপক্ষের অপ্রিয়ভাজন হতে হয়। শেষমেষ কিছুই করতে পারবে না, কিন্তু হয়রানি ও কষ্ট দিতে চাইলে তারা দিতেই পারে। এক একটি বিমানবন্দরে কর্তৃপক্ষও কম থাকেনা - বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, নিরাপত্তা, কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, ক্যারিয়ার বা বিমান সংস্থা। কেউ কারো অধীন নয় - সবাই স্বাধীন। কাজেই যে কোন একটি কর্তৃপক্ষ আপনাকে আটকাবে ঠিক করলে অন্য কারো সেখানে কিছু বলার নেই।

ঢাকা বিমানবন্দর নিয়ে আমার এই ভয়টি অমূলক নয়, ভয়টি ঢুকে গিয়েছে ষোল বছর আগে ডাটা ব্যাক-আপের জন্য একটি এক্সটার্নাল টেপ ড্রাইভ নিয়ে আসার অপরাধে আমাকে রাত আটটা থেকে দুটা পর্যন্ত বিমানবন্দরে থাকতে হয়েছিলো বলে। আমার অপরাধ - এমন একটি জিনিস এনেছি যা কাস্টমসের কোন কর্তাই চিনতে পারছেন না, বলার পরও বুঝতে পারছেন না, এবং তারচেয়েও ভয়াবহ এর ওপর ডিউটি আরোপ করার জন্য কোন ক্যাটেগরীর পণ্যে ফেলা হবে সে বিষয়ে কাস্টমসের ট্যারিফ বইতে কোন নির্দেশনাও পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই যাত্রীকে অপেক্ষায় বসিয়ে রাখো। পরে পরে বুঝে গিয়েছি কী করতে হবে - দরকারী হলেও ঝামেলার কোন জিনিস বিদেশ থেকে আনি না, কেউ মেরে কেটে অনুরোধ করলেও না।

তবু ভয় পাই - বিমানবন্দরের ভেতরেতো যে কেউ হয়রানি করতেই পারে, বেরুতে না বেরুতেও হয়রানির শেষ নেই। ট্রলি নিয়ে হয়রানি, ভিক্ষুক ও ভিক্ষুকবেশী অন্য লোকজনের হয়রানি, ট্যাক্সির হয়রানি, বাইরে থেকে টেক্সি ডাকতে গেলে পুলিশের হয়রানি, যাত্রি বিদায় দিতে গেলে মাঝপথে সবাইকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়ার হয়রানি, বোর্ডিং পাস পেয়ে যাবার পর প্রিয়জনদের সাথে দেখা না করতে দেয়ার হয়রানি, যাত্রির প্রিয়জনদের টার্মিনালে না ঢুকতে দেয়ার হয়রানি, গাড়িকে নির্ধারিত ড্রপ-অফ জোনেও দাঁড়াতে না দেয়ার হয়রানি - হয়রানির কোন অন্ত নেই এই বিমানবন্দরটিতে। এর নাম জিয়া হলেই কী আর শাহজালাল হলেই কী!!

প্রতিবারই তাই ঢাকা বিমানবন্দরে শংকিত থাকি আমার 'চলন বাঁকা' দেখায় কিনা এই ভয়ে। গেল কয়েকবার তাই এমন একজন বন্ধুকে আগে থেকেই যোগাযোগ করি, উর্ধ্বতন পদে কর্মরত থাকার সুবাদে যে ঢাকা বিমানবন্দরে আমার যাত্রাকে মসৃন ও শংকাহীন করতে পারে। সংগত কারণে বন্ধুর আর কোন পরিচয় প্রকাশ করলাম না। আমার ফোন পেলেই তার অধস্তন এক বা দুইজন কর্মচারী আমাকে বিমানবন্দরে সার্বক্ষণিক সঙ্গ দেয়, রিসিভ করা থেকে বোর্ডিং ব্রীজের সিকিউরিটি চেকআপ পর্যন্ত তাঁরা সারাক্ষণই সাথে থাকেন এবং সব কাজে সাহায্য করেন - ব্যাগ টানাটানি থেকে, সিকিউরিটি স্ক্যানিং, চেকড ব্যাগেজ ড্রপ করা, বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করার সময় সাথে থাকা, এমবার্কেশন ফর্ম পূরণ করা, পরিচিত ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে আমার পরিচয় জানিয়ে শুরুতেই পরিবেশকে বন্ধুসুলভ করে দেয়া, এরপর আমার সময় কাটানোর জন্য স্রেফ বন্ধুসঙ্গ, এবং সবশেষে বোর্ডিং ব্রীজে আমাকে বিদায় জানানোর আগে তাঁদেরই মোবাইল থেকে আমাকে প্রিয়জনদের সাথে আরেকবার কথা বলিয়ে দেয়া। এরচেয়ে বেশি সুযোগ পৃথিবীর কোন বিমানবন্দরে আমাকে কেউ কোনদিন দেবে না, কিন্তু মনে মনে একটু ছোট হয়ে থাকি মসৃন যাত্রার সুযোগটি আমি স্বাভাবিক নিয়মে না পেয়ে একটি অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে ভোগ করি বলে। তবে আমি যথাসাধ্য নিয়মের মধ্যে থেকেই তাঁদের সাহায্যগুলো গ্রহন করি। গেলবার বিদেশী পাসপোর্টধারীদের ছোট লাইন থেকে বোর্ডিং করিয়ে দেয়ার প্রস্তাবটি আমি বিনীতভাবেই প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীদের লম্বা লাইনের পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম - শুধুই নৈতিকতার জন্য তা নয়, কোন কর্তৃপক্ষকে হয়রানির সুযোগ দিতে চাই না বলেও। সাহায্যকারীদের আমি জ্ঞানত কোন অনৈতিক সুবিধা ভোগের জন্য ব্যবহার করিনি। এবং এই সুবিধা ভোগ করতে গিয়ে আমি আরেকজনের সুবিধা কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছি বলেও মনে হয় না। একজন যাত্রী হিসাবে যে সেবা আমার প্রাপ্য তা যথাযথ বুঝে নিতে তাঁদের পরিচিতিকে ব্যবহার করা কি খুব অন্যায়? জানি কিছুটা অন্যায় এই অর্থে যে আমি ব্যাক্তি পরিচয়কে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করেছি, কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে যাত্রীসেবা যদি পেতাম তবে তো আমাকে এই পথে যেতে হতো না!

ঢাকা বিমানবন্দরভীতি আছে এরকম যাত্রী আমিই একমাত্র কিনা, বা স্বল্পসংখ্যকদের একজন কিনা জানি না। যদি তাই হয়, তবে আমার বা আমাদের জন্য ড্যাকফোবিয়া (DACphobia) নামে নতুন একটি মানসিক রোগের নাম দেয়া যাবে। আর রোগটির কথা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আমার নেয়া সকল সুবিধাকে পাগলের কাজ বলে জায়েজ করে নিতে পারবো, নয়তো মনের কোথায় একটু খচখচ করেই।

(অসমাপ্ত)

1 comments:

  1. Sayedur R Chowdhury This comment has been removed by the author. May 30, 2010 at 4:18 PM

Post a Comment