কুয়েত বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন। একটু আগেই ঢাকা থেকে এসে নেমেছি, পরবর্তি গন্তব্য লন্ডন। হাতে চার ঘন্টার মত সময় আছে। দ্বিতীয়বারের মত আরেকটা সিগারেট ধরালাম স্মোকিং কিউবিকলের ভেতর দাঁড়িয়ে। যদিও আরবীয়রা স্মোকিং জোনের বাইরেই দিব্যি ধূমপান করছে দেখতে পাচ্ছি। একজন লোক এসে লাইটার চাইলো। অনেক কসরত করে ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে দেশলাই পাচার করে এনেছি, সহজে তা খরচ হতে দেয়া যায় না। সিগারেট থেকে সিগারেট ধরিয়ে নিতে দিলাম। তারপর একটু ঘুরে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম উৎসুক হয়ে আমার দিকেই চেয়ে আছে লোকটি। এবার আমিও ঘুরে তার মুখোমুখি হলাম, একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলাম, সাধারণ গড়নের একজন পরিশ্রমী কর্মজীবি বাংলাদেশি দেখতে যেমন হয় তেমনি, তেমন কোন শারীরিক বা চেহারার বিশেষত্ব নেই। শ্যামলা থেকেও কালোর দিকে গায়ের রং, মুখের ত্বকে যতটা না বয়সের তার চেয়ে বেশি পরিশ্রমের ভাঁজ। মাথার চুল কিছুটা অবিন্যস্ত, ছোট করে ছাঁটা কাঁচাপাকা গোঁফ, পোষাক এবং হাতের ব্যাগও আমারগুলোর মতই খুব সাধারণ। কোনরকমের বাহ্যিক আভিজাত্য চোখে পড়ছে না। ভদ্রতা করে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথা থেকে আসছেন, কোথায় যাচ্ছেন? অজানা কোন এক ভাষায় কিছু একটা বললো লোকটা। ইংরেজি হয়তো বলে না বুঝতে পেরে ক্রিয়াপদবিহীন ইংরেজিতে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, অ্যানী ইংলিশ? জবাব এলো, নো অ্যানী ইংলিশ। পূর্ব বা পূর্ব-মধ্য ভারতীয় হতে পারে ভেবে আবার বললাম, অ্যানী হিন্দি? এবার জবাব এলো, উর্দু।
আমার ভাঙ্গাচোরা হিন্দি-উর্দু মিশিয়ে জানতে চাইলাম, পাকিস্তানী নাকি ভারতীয়। জানলাম, পাকিস্তানী। ভাবলাম সিন্ধী গ্রাম বা মফস্বলের মানুষ হতে পারে। সরাসরি জানতে না চেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথা থেকে আসছেন?
জবাব এলো, ঢাকা। রীতিমত দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম।
~ ঢাকায় কেন?
~ ব্যবসা করি, ব্যবসার কাজে বিভিন্ন জায়গায় যাই।
~ বাংলা বুঝেন?
~ না, চাটিগাঁইয়া মাতিত পারি। বাইরের লোক যেভাবে চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলে সেভাবেই বললো। বেশ কষ্টই হলো বলতে লোকটির। বুঝলাম অল্পসল্প পারে। খুব অবাক হলেও তা লুকালাম। ধীরে ধীরে উচ্চারন করে আমি জানতে চাইলাম, অনে চাটিগাঁইয়া কেনে মাতিত পারন (আপনি চাটগাইয়া কিভাবে বলতে পারেন?)
~ ব্যবসার হাজে যাআ পরে (ব্যবসার কাজে যেতে হয়)।
তখনি আমার মনে পড়লো লোকটি প্রথমে আমার কথার জবাব দিয়েছিলো কোন একটি অজানা ভাষায়। জানতে চাইলে বললো, বর্মাইয়া। চিন্তিত হলাম, লোকটি প্রথমেই মাতৃভাষা ব্যবহার না করে বার্মার ভাষায় কেন কথা বললো। ততক্ষণে আমার সকল ইন্দ্রিয় যতটা পারা যায় সজাগ করে তুললাম, লোকটির দেয়া পরিচয়গুলো কেন যেন আর বিশ্বাস করতে পারছিনা। আন্তর্জাতিক রুটগুলোয় বহু রকমের প্রতারক ও সংঘবদ্ধ অপরাধিরা চলাফেরা করে - সতর্ক থাকাই ভালো। এবং প্রায় সাথে সাথেই ভান করলাম তার সাথে আর কথা চালানোয় আমার কোন আগ্রহ নেই। আড়চোখে চোখ রেখেও একটু ঘুরে দাঁড়ালাম। লোকটি এবার অনুরোধের সুরেই বললো, আমাকে একটু সাহায্য করবেন?
~ কি ধরনের সাহায্য?
~ আমার একটা ফোন করা দরকার, আপনার কাছে মোবাইল আছে?
~ আছে, কিন্তু আমার মোবাইল এখানে কাজ করছেনা।
~ কিভাবে ফোন করতে পারি একটু বলবেন?
এই যাবতীয় কথাবার্তা হচ্ছে চাটগাঁইয়া আর হিন্দি-উর্দুর এক অদ্ভুত মিশেলে।
~ ফোন বুথ আছে অনেক, পয়সা ফেলে কথা বলতে পারেন।
~ আমার কাছে কুয়েতি পয়সা নাই।
একই সমস্যা আমারও হয়েছে, কুয়েতি কারেন্সি না থাকায় আমিও ফোনগুলো ব্যবহার করতে পারিনি। ক্রেডিটকার্ড ব্যবহার করা যায় এমন ফোনবুথ বা ক্রেডিটকার্ড দিয়ে কিনতে পারবো এমন কোন ফোনকার্ড বা ক্রেডিটকার্ডে ক্যাশব্যাক কোন ধরনের সুবিধাই পেলাম না এয়ারপোর্টটিতে। বাধ্য হয়ে আমি অন্য পন্থা নিয়েছিলাম। লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম কোন দেশের টাকা আছে তার কাছে। বললো সৌদি রিয়াল আর বাংলাদেশি টাকা।
~ ঠিক আছে, অপেক্ষা করুন। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
যে বাংলাদেশি ক্লিনারের মোবাইল ফোন ব্যবহার করেছি আমি একটু আগেই, তার এদিকে আসার অপেক্ষায় থেকে আরেকটা সিগারেট ধরালাম।
(অসমাপ্ত)
Copyright 2010 সাইদুর রহমান চৌধুরী
Theme designed by Lorelei Web Design
Blogger Templates by Blogger Template Place | supported by One-4-All
0 comments:
Post a Comment