আমার নামের বানানে একটি অনিচ্ছাকৃত ভুল আছে, সাইদুর এর 'ই'-টি আসলে 'ঈ' হওয়া উচিত ছিলো। নামটি আরবী, বাংলা বর্ণ দিয়ে সব আরবী ধ্বনি সঠিকভাবে উচ্চারন সম্ভব নয়, তবু উচ্চারনের কাছাকাছি যেতে গেলে 'ঈ' ব্যবহার করলে বেশি উপযুক্ত হতো। নবম শ্রেনীর পাঠ শুরু হওয়া পর্যন্ত আমার নাম ছিলোও 'ঈ' দিয়ে। কিন্তু শিক্ষাবোর্ডের নিবন্ধনের সময় আমাদের শিক্ষকরা আমাদের হাতে ফর্মগুলো পূরণ করার জন্য না দিয়ে নিজেরাই পূরণ করেছেন, কেউ কাটাছেড়া করে ফর্ম নষ্ট করবে ভেবেই হয়তো। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার ফর্মটি যিনিই পূরণ করে থাকুন, আমাকে 'সাইদুর' বানিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। নিবন্ধন কার্ডটি যখন হাতে পেলাম তখনই দেখলাম এই বিভ্রাট। আমার বাবা দেখতে পেলে তখনই এটা নিয়ে পাড়া মাথায় তুলতেন, এবং ঠিক করিয়েই ছাড়তেন। কিন্তু কেন যেন বাবাকে জানানো হয়নি ভুলটির কথা। বাংলার সাথে মিল রাখার জন্য ইংরেজি থেকেও একটি e বাদ দিয়ে ফেললাম।
এরপর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন একবার ভাবলাম নামটি ঠিক করে ফেলি। কিন্তু আদালতে গিয়ে অ্যাফিডেভিড, এবং কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে এসএসসি ও এইচএসসি-র কাগজপত্র ঠিকঠাক করে আনার যে ঝক্কি ও আর্থিক সংশ্লেষ তা মনে করে উদ্যম হারিয়ে ফেললাম। আর এখন ঠিক করতে চাইলে তো এরপরের সার্টিফিকেটগুলো, বিয়ের ও জন্মনিবন্ধনের কাগজ, স্ত্রী-সন্তানদের পাসপোর্ট, সন্তানদের জন্মনিবন্ধনপত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স সবকিছু পরিবর্তন করতে গিয়ে জীবনই শেষ হবে। তাই আমি সাইদুর-ই রয়ে গেলাম।
নিজের নামের বানানের এই ভুলের কথা মনে পড়লো একজন দেশবরেণ্য শ্রদ্ধেয় মানুষের নামের কথা মনে পড়ায় - তিনি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান। আরবী হিসাবে তাঁর নামও মুনীরুজ্জামান হলে বেশি উপযুক্ত হতো। তাঁর নামের বানানের পেছনেও কোন গল্প আছে কিনা তা জানার সুযোগ হয়তো হবে না কোনদিন, তবে তাঁকে মনে পড়লো তিনি বাংলা একাডেমীর বাংলা বানান প্রমিতকরণ দলের একজন বিশেষজ্ঞ সদস্য ছিলেন, তাই।
নতুন প্রমিত বাংলা বানানে পরামর্শ দেয়া হয়েছে দেশের নামের শেষে ী ব্যবহার না করে ি ব্যবহার করতে হবে, যেমন: জার্মানি, ইতালি। একইভাবে মাসের নামেও ি, যেমন: জানুয়ারি, ফ্রেব্রুয়ারি। একই রকম আরো আছে, যেমন: বায়োলজি, হিস্ট্রি।
উপরের এই শব্দগুলোর সবকটি ইংরেজি বানানে শেষ হয়েছে y দিয়ে। ইংরেজি ভাষার প্রধান প্রধান প্রায় সবকটি লেক্সিকনে ও উচ্চারণ গাইডে বলা হয়েছে শব্দের শেষে y থাকলে তার উচ্চারন হ্রস্ব-i না হয়ে দীর্ঘ-i হবে, অর্থাৎ বাংলা বর্ণ ব্যবহার করলে ই (ি) না হয়ে ঈ (ী) হওয়াই বেশি উপযুক্ত মনে করার কারণ আছে।
এক ভাষার মানুষ অন্য ভাষার শব্দ উচ্চারণের সুবিধার জন্য এবং এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুলিখন (transliteration) এর জন্য প্রবর্তিত হয়েছে International Phonetic Alphabet (IPA)। বাংলা একাডেমীর বাংলা বানান প্রমিতকরণের ক্ষেত্রে বিদেশি শব্দের জন্য IPA-কে বিবেচনায় আনা হয়েছিলো কিনা জানা যায় না, তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় IPA-র কোন বিবেচনা করা হয়নি। করা হলে y দিয়ে শেষ হওয়া শব্দগুলো ী দিয়েই করার প্রস্তাব করা হতো। এই যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রীতিনীতির সাথে সামঞ্জস্য না রাখা, এটা বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে একটি বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ভাষা হিসাবে গ্রহনযোগ্য হতে কতটুকু সাহায্য করবে তা বাংলা একাডেমীই ভালো জানে, কিন্তু আমি খুবই অবাক হই এই প্রমিত বানান প্রস্তাব করার পরও বাংলা একাডেমী যখন নিজেই তা লঙ্ঘন করে 'একাডেমী' লিখে, তাদেরই নিয়মে তা 'একাডেমি' হওয়া উচিত।
আমি ব্যক্তিগতভাবে IPA রীতিনীতি ও প্রধান প্রধান লেক্সিকনগুলোর উচ্চারণরীতির আলোকে জার্মানী, ইতালী, জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী, বায়োলজী, হিস্ট্রী, একাডেমী এভাবে লেখাকেই বেশি উপযুক্ত মনে করি, এবং লিখিও। প্রমিতকরণের নিয়মগুলোর যথোপযুক্ত ব্যাখ্যা বাংলা একাডেমীর কাছ থেকে কখনো পাওয়া গেলে আবার পর্যালোচনা করে দেখতাম আমি ভুল পথে আছি কিনা।
সম্পর্কিত পুরনো পোস্ট:
৪. ইংরেজী শব্দের বাংলা বানানঃ ইউ বনাম ইও এবং আয়ো
৩. ইংরেজী শব্দের বাংলা বানানঃ এ বনাম এই
২. ইংরেজী শব্দের বাংলা বানানঃ অ বনাম ও
১. ইংরেজী শব্দের বাংলা বানানঃ এ বনাম অ্যা
Copyright 2010 সাইদুর রহমান চৌধুরী
Theme designed by Lorelei Web Design
Blogger Templates by Blogger Template Place | supported by One-4-All
0 comments:
Post a Comment