পূর্বসূত্রঃ অতপর আমি দত্তক হয়ে গেলাম

"অতপর আমি দত্তক হয়ে গেলাম"-এর শেষ দিকে মন্তব্যের ঘরে আপডেট হিসাবে উল্লেখ করেছিলাম -
"এই মাত্র টিফানী জানালো, খ্রিসমাস ইভে (২৪ ডিসেম্বর) ওর বাবা-মা-ভাই সহ চার্চে যাবে প্রার্থনার জন্য, বিকেলে ডিনার। এবং জানতে চাইলো দাওয়াত গ্রহন করতে আমার আপত্তি আছে কি না। আমার মনে হয়, চার্চের ব্যাপারটাও দেখে আসা দরকার।"

বলাই বাহুল্য আমি দাওয়াত গ্রহন করেছিলাম চার্চের বিষয় আশয় এবং একটি পরিবারের ট্যাডিশনাল বড়দিন উদযাপন দেখার লোভে। পরে একটু দমে গিয়েছিলাম যখন জানলাম তাদের পরিবার উইনিপেগে থাকে না, থাকে তাদের হোম টাউন ব্রানকিল্ডে, আর সেখানেই হবে তাদের খ্রিসমাস। তবু কয়েকদফা মেসেজ চালাচালির পর ঠিক হলো ২৪ তারিখ (গতকাল) বিকেল ৪:১৫তে টিফানী আমাকে তুলে নেবে।


কথামতোই ঠিক ৪:১৫তে তার গাড়িতে চাপলাম। ব্রানকিড উইনিপেগ থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার, ১১০ কিলোমিটারের হাইওয়েতে সর্বোচ্চ আধঘন্টা লাগার কথা, কিন্তু আগের রাত থেকে শুরু হওয়া তুষারপাতের জন্য রাস্তা খুবই পিচ্ছিল, লেগে গেল প্রায় চল্লিশ মিনিটেরও বেশি। পাঁচটায় প্রার্থনা (চার্চ সার্ভিস), আমরা পৌছালাম কেবলই তার ২/১ মিনিট আগে।

সেন্ট পলস্ ইভানজেলিকাল লুথেরান চার্চ, প্যাস্টর একজন নারী, রেভারেন্ড লেজলি পুলিন। জানলাম
তারা ক্যাথলিক নয় বলে নারী প্যাস্টরে সমস্যা নেই। ক্যাথলিক হলে নারী প্যাস্টর দুরে থাক, নারী প্রার্থনা কারীরা গির্জার ভেতর কথাই বলতে (মুখ খুলতে) পারবেনা। পুরুষ হলে যা খুশি কথা বলা যাবে!


আমরা যখন গির্জায় প্রবেশ করি , ততক্ষণে শহরের সবাই চলে এসেছে। চার্চের ভেতরে ঢুকেই মাত্র ১ মিনিটে যে কয়টি পারা যায় ছবি তুলে নিলাম
, সার্ভিস শুরুর প্রস্তুতি চলছে বলে আমার ছবি তোলার কাজ আর এগুলো না। প্রার্থনা চলাকালীন ছবি তোলা যাবে না, আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ঢোকার মুখেই সবার হাতে দিয়ে দেয়া হয়েছে ছাপানো সার্ভিস বুকলেট। দরজায় দাড়ানো সেবচ্ছাসেবক অ্যানা আমার পরিচয় পেয়েই বললেন, "হ্যাপী খ্রিসমাস। ইউ কেম অল ওয়ে ডাউন টু সী আওয়ার খ্রিসমাস!! ইউ গেট মাই হাগ।" অতপর ওদের কায়দায় কোলাকোলি। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন টিফানীর খালা, আরেক স্বেচ্ছাসেবক, আমাকে দেখেই বললেন, "ইউ মাস্ট বি সায়য়েদ? ইউ গেট আ হাগ হিয়ার ঠু!" তারপর একে একে এই কোলাকোলি পর্ব আরো অনেকদুর চলতো যদি না সার্ভিস শুরুর ঘোষনা সময়মত এসে পড়তো।




অতএব টিফানী আর তার মায়ের সাথে বসে পড়লাম সামনের একটা বেঞ্চিতে। সার্ভিস শুরু হোল দ্য বেলস অব খ্রিসমাস মিউজিক দিয়ে, পেছেনে মিউজিসিয়ান ক্যালি এলপার পিয়ানো বাজাচ্ছে, প্যাস্টর সামনের বেদীতে দাড়িয়ে গাইছে, সাথে গির্জাভর্তি সবাই (আমি ছাড়া) বই দেখে দেখে গলা মেলাচ্ছে।

মিউজিকের পর প্যাস্টর বললেন - The waiting is over!
সবাই সমস্বরে বললো - The dreaming has given birth to a new reality.
প্যাস্টর - The source of our healing has come near
সবাই - God's promise has been fulfilled.
ইত্যাদি ইত্যাদি।

তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘোষনা হলো, "ডিয়ার চিলড্রেন অব খ্রাইস্ট, উই হ্যাভ আ গেস্ট হিয়ার টুনাইট। প্লীজ ওয়েলকাম সাইয়েদ, হি কেম হাফ ওয়ে রাউন্ড দ্য আর্থ ফ্রম বাংলাদেশ টু বি অ্যান হনার্ড স্পেক্টেটর অ্যাট টুনাইটস সার্ভিস। প্লীজ গিভ হিম অ্যান অ্যাপ্লজ।" সবাই করতালি দিলো, আমি হলভর্তি সবার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে, মাথা ঝাকিয়ে তার জবাব দিলাম। এরপর যিশুর মোমবাতি জ্বালানো হলো। আবার কিছুক্ষণ প্যাস্টর-প্রার্থনাকারীদের যুগলবন্দি চললো। পড়ে শোনানো হলো বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট থেকে।

এর পরের পর্বটি ছিল সত্যি আকর্ষণীয়, প্যাস্টর সহ ৬ জনের গায়ক দল পিয়ানোর সাথে সাথে গাইল বিউটিফুল স্টার অব বেথলহেম। সুমধুর সঙ্গীত। এভাবে পর্যায়ক্রমে চলতেই থাকলো কোরাস, যুগলবন্দি, বাইবেল পাঠ, গায়কদের গান - অন্তত ৩/৪ দফা। মাঝে দুই জন প্রার্থনাকারী বাইবেলের একটি করে বাণী ব্যাখ্যা করলেন ডায়াসে দাড়িয়ে। তারপর এলো প্যাস্টরের সারমন - অনেকটা মুসলমানের খুতবার মত।

শেষে আমাদের সবার হাতে ধরা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে নিভিয়ে দেয়া হলো হলের সব বাতি পিয়ানো আর রবিনের বাজানো গিটারের সাথে প্যাস্টর মধুর একটি গান গাইলেন। মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে বাতি আবার যখর জ্বললো প্রার্থনা তখন শেষ। আমার কানে কানে টিফানী বললো, এরপর আমরা যা করবো তুমি তাতে যেওনা, তোমার বিশ্বাসের সাথে তার সংঘর্ষ হতে পারে। এ পর্যায়ে দশ জন দশ করে প্রার্থনাকারী বেদীতে গিয়ে হাটু গেড়ে বসেন আর প্যাস্টর তাদের খাইয়ে দেন যিশুর শরীরের অংশরুপী ওয়েফার, পান করিয়ে দেন যিশুর লাস্ট সাপার থেকে প্রতিকী পাওয়া ওয়াইন।

সব শেষ হলে আরো কটি ছবি নিতে চাইলাম, কিন্তু টিফানী একরকম টেনে নিয়ে চললো আমাকে, বললো, ডিনারের দেরী হয়ে যাবে, সবাই ক্ষুধার্ত। তখন বাজে ৬টা - আসলেই ডিনারের সময় পেরিয়ে গিয়েছে অনেক আগে!! অগত্যা ২/৩ টি ছবি তুলেই আমাকে বেরিয়ে পড়তে হোল।







(চলবে)

0 comments:

Post a Comment