১৯৬২ সালে আমেরিকাতে একটি ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলো। র‌্যাচেল কার্সন নামের এক নারী লেখক ও সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী তাঁর চার নম্বর বইটি প্রকাশ করলেন। আগেই তিনি ভালো লেখক হিসাবে সুনাম কুড়িয়েছেন সমুদ্র নিয়ে তিন তিনটি খুব জনপ্রিয় বই লিখে। কিন্তু এবারের বইটি সাড়া ফেলে দিলো অন্যরকম। এবার আর সমুদ্র নিয়ে নয়, লিখলেন একেবারে নতুন একটি বিষয় নিয়ে।

বেশ কিছু বছর ধরেই কৃত্রিম ও রাসায়নিক কীটনাশক বিষের ব্যবহার নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন র‌্যাচেল। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর উপর এসব বিষের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে তিনি অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধ এর মধ্যে পড়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার সামরিক বাহিনীর টাকায় অনেক রকমের কীটনাশক উদ্ভাবন করা হয় বিভিন্ন গবেষণাগারে। এর অনেকগুলোই ফসলের উপর প্রয়োগ করা শুরু হয় সে সময় থেকেই। বিষগুলো ফসলের মাঠে দেয়া হয় ফসলের জন্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গকে মেরে ফেলার জন্য, কিন্তু কীটপতঙ্গ খেয়ে জীবন ধারণ করে যেসব পাখি ও অন্যান্য প্রাণী, তারা এসব বিষাক্ত ও মৃত পোকামাকড় খেয়ে মরে যেতে থাকলো। যে ফসলে বিষ দেয়া হচ্ছে সে ফসল ও খাদ্য থেকে কিছু কিছু বিষ মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ক্যান্সার ও অনেক অজানা রোগ সৃষ্টি করতে লাগলো মানবদেহে। প্রায় এক যুগ র‌্যাচেল তাঁর উদ্বেগ চেপে রেখে দেখে যেতে লাগলেন আর পড়তে লাগলেন বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য বিষয়ের প্রবন্ধগুলো। এর মধ্যে ১৯৫৭ সালে আমেরিকার কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) ফসলের মাঠে পিপড়া মারার জন্য বড় ধরনের অভিযান শুরু করলো। তারা পিপড়া মারার জন্য ডিডিটি পাউডার নামের খুব বিষাক্ত একটা রাসায়নিক পদার্থ এক রকমের তেলের সাথে মিশিয়ে বিমান থেকে যত্রতত্র ছিটিয়ে দিতে শুরু করলো। যাদের জমিতে এই বিষ ছিটানো হলো তারা প্রায় সকলেই এর ক্ষতিকর প্রভাব টের পেতে শুরু করলেন। র্যারচেল ঠিক করলেন, আর নয়, এ নিয়েই পরের বইটি লিখবেন।



শুরু হলো র‌্যাচেলের ব্যাক্তিগত গবেষণা। তিনি ডিডিটি ও অন্যান্য বিষের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধগুলো পড়ার পাশাপাশি যেসব জায়গায় বিষের ক্ষতির প্রমান পাওয়া গিয়েছে সেসব উদাহরণ হিসাবে জোগাড় করতে শুরু করলেন। নিজে সরকারী একটি বিভাগের বিজ্ঞান লেখক হিসাবে কাজ করার সুবাদে তাঁর সাথে অনেক সরকারী বিভাগের বিজ্ঞানীদের সাথে যোগাযোগ ছিলো, সেসব বিজ্ঞানীদের কাছ থেকেও পরিবেশের উপর এসব বিষ প্রয়োগের কুফল বিষয়ে তথ্য-প্রমান এবং মতামত সংগ্রহ করতে শুরু করলেন র্যা চেল। টানা চার বছর গবেষণা করার পর যে বইটি লিখলেন, তার নাম দিলেন ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বা নীরব বসন্ত।

বইয়ের অষ্টম অধ্যায়ে র‌্যাচেল লিখেছেন কিভাবে ডিডিটি, হেপ্টাক্লোর, এনড্রিন, ডাইয়েলড্রিন – এসব কীটনাশক ছিটানোর ফলে গাছপালা, উপকারী কীটপতঙ্গ, এমনকি মাটি ও কেঁচো বিষাক্ত হয়ে যাবার প্রমান মিলেছে, আর কেঁচোর উপর নির্ভরশীল শত শত পাখি হারিয়ে গিয়েছে কোন কোন এলাকা থেকে। বিষের প্রভাবে হয় তারা মারা পড়েছে দলে দলে, নয়তো তাদের ডিম দেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, অথবা ডিম দিয়েছে কিন্তু বিষের ক্রিয়ায় ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়নি। এভাবে পাখির কলকাকলীতে মুখর আমেরিকার অনেক অঞ্চল পাখিহীন মৃতপুরীর মতো হয়ে গিয়েছিলো। এই অধ্যায়টিরই প্রথমে র্যাহচেল নাম দিয়েছিলেন ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’। পরে গোটা বইটিরই নাম ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ দিয়ে অধ্যায়টিকে নাম দেন ‘অ্যান্ড নো বার্ডস সিং’।

প্রকাশের পর পরই বইটি অনেক সেরা বইয়ের তালিকায় স্থান পেয়ে গেলো। কেউ কেউ বইটিকে ‘সর্বকালের সেরা পঁচিশ বিজ্ঞানের বই’-এর তালিকায় স্থান দিয়েছেন। আরেকদল একে স্থান দিয়েছেন ‘ইতিহাস বদলকারী ৬০টি বই’-এর তালিকায়। এসব তালিকায় আরো যেসব বই স্থান পেয়েছে সেগুলো হলো মহাবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, বিজ্ঞানী আইজাক নিউটন, জোতির্বিদ কোপার্নিকাস, বিবর্তন তত্ত্বের জনক ডারউইন-এর মতো মহামনীষীদের লেখা বইগুলো। কাজেই বোঝাই যায় আমাদের দেশে খুব একটা নাম শোনা না গেলেও র‌্যাচেল কার্সন ও তার বইয়ের একটি বিরাট ভুমিকা রয়েছে মানবমঙ্গলে।

এই বইটি পড়ার পরই আমেরিকার মানুষের মধ্যে বড় ধরনের একটি জাগরণ তৈরী হলো। মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে এসব বিষাক্ত পদার্থ নির্বিচারে ব্যবহারের বিরুদ্ধে এবং সব ধরণের পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু করলো। দশ বছর আন্দোলনের পর অবশেষে আমেরিকায় ১৯৭২ সালে ডিডিটি-র ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষনা করলো সরকার। এসব আন্দোলনের ফলেই আমেরিকা সরকার সেদেশে ‘এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন অ্যাজেন্সী’ বা পরিবেশ সংরক্ষণ বিভাগ চালু করলো; এবং বায়ু, পানি, মাটি এসব দূষণ বন্ধ করতে বিভিন্ন আইন জারী করলো। বলা হয়ে থাকে র্যা চেল কার্সনের সাইলেন্ট স্প্রীং বইটিই আমেরিকাতে ও পরে বিশ্বের অন্যান্য দেশে পরিবেশ আন্দোলনের সূচনা করেছিলো। এ কথা সত্য যে এই বইটিরও অনেক আগে থেকেই কিছু কিছু পরিবেশবাদী সংগঠন ও আন্দোলন আমেরিকা ও ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশে পরিবেশের উপর মানুষের অপিরনামদর্শী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলো, কিন্তু এই বইটি পড়ে আমেরিকায় ব্যবকহারে ডিডিটি ও দূষণ বিরোধী যে গণজোয়ার তৈরী হয়েছিলো তা এর আগের কয়েক দশকেও দেখা যায়নি। যে সব কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান এসব বিষাক্ত দ্রব্য উৎপাদন করতো আগে কখনো পরিবেশ আন্দোলনের ফলে তাদেরকে উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ার মতো অবস্থায় পড়তে হয়নি, কিন্তু এবারই প্রথম তাদের ব্যবসা রীতিমতো বন্ধ হবার উপক্রম হলো। মনে হতে পারে যে শিল্প উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি দেশের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু আসলেই কি তাই? পৃথিবীর কোন বিবেকবান মানুষ কি অস্ত্র, গোলাবারুদ, মিসাইল ও পারমানবিক বোমার উৎপাদনের জন্য কারখানা দেখতে চায়? এসব কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়াই মানুষের জন্য মঙ্গল। তাই বিষাক্ত পদার্থের উৎপাদন বন্ধ হওয়াও সে সময় পরিবেশ সচেতন ও ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ মঙ্গল মনে করেছেন। কিন্তু যারা এসব কারখানার মালিক তারা আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে সবসময়ই নারাজ। তাই তারা র্যারচেল কার্সনের বিরুদ্ধে পাল্টা অপপ্রচার চালানো শুরু করলো। অনেক টাকার বিনিময়ে তারা পত্রিকায় কলাম লেখক থেকে শুরু করে কিছু কিছু লোভী বিজ্ঞানীকে পর্যন্ত হাত করে ফেললো র‌্যাচেলের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রকাশ করার জন্য। বিজ্ঞান যখনই কিছু সত্য প্রকাশ করে তখনই সেই সত্য দিয়ে কিছু মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরকম ঘটেছিলো গ্যালেলিও গ্যালিলাই-এর সময় – যখন তিনি বললেন সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী ও অন্য গ্রহগুলো ঘোরে, তখন গির্জার পাদ্রিরা ক্ষতিগ্রস্থ হতে যাচ্ছিলেন, তাই তাঁরা দন্ড দিলেন গ্যালেলিওকে। একই রকম ঘটনা এর পরেও অনেকবার ঘটেছে। যখন বিজ্ঞান প্রমান করলো ধূমপান খুব ক্ষতিকর, তখনও তামাক ও সিগারেট ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে অনেক টাকার বিনিময়ে কিছু পত্রিকা লেখক ও লোভী নীতিহীন বিজ্ঞানীকে দিয়ে প্রচার চালিয়েছে অনেক বছর যে ধূমপানে কোন ক্ষতি হয় না। এখনও বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের ফলে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে বন্যা, খরা, ঘুর্ণিঝড় এসব দূর্যোগ বেড়ে যাওয়ার কথা যখন বলছেন বিজ্ঞানীরা, তখন তেল ও কয়লা ব্যবসায়ীরা ক্ষতির ভয়ে টাকা দিয়ে লোক লাগিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানকে ভুল বলে প্রচার করার জন্য। র‌্যাচেলের ক্ষেত্রেও এক শ্রেণীর রাসায়নিক ব্যবসায়ী উঠে পড়ে লেগেছিলেন তাঁর বইটি ভুল প্রমান করার জন্য। কিন্তু আনন্দের কথা, মানুষের আন্দোলন ও বিজ্ঞানের অকাট্য প্রমানের কাছে তাদের ঠুনকো যুক্তিগুলো খুব বেশিদিন টেকেনি।


র‌্যাচেলের বইয়ের ছয় বছর পর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে অ্যাপোলো ৮ নভোযানের অভিযান। আমরা সবাই জানি অ্যাপোলো ১১ অভিযানে মানুষ প্রথম চাঁদে অবতরণ করেছিলো। কিন্তু এর আগে অনেকগুলো পরীক্ষামূলক মহাকাশযাত্রা করতে হয়েছিলো নভোচারিদের। অ্যাপোলো ৮ অভিযান ছিলো তেমনই একটি পরীক্ষামূলক যাত্রা। এই অভিযানটিই ছিলো পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে মহাকাশে মানুষের প্রথম অভিযান। এর আগে মানুষ মহাকাশে গিয়েছে কিন্তু পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে যায়নি। এই অভিযানে মাহকাশযানটি চাঁদেও চলে গিয়েছিলো, শুধু ‘লুনার মডিউল’ নামের বিশেষ যানটি তখনো তৈরী হয়নি বলে এ যাত্রা চাঁদে নামতে পারে নি। তাই এই অভিযান চাঁদে যাবার প্রস্ততি হিসাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অন্য যে তুচ্ছ কারণে এই অভিযানটি পরে খুব মর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা ছিলো এই অভিযানেই প্রথম নভোচারিরা বাইরে থেকে পৃথিবীটাকে ছোট্ট একটা গ্রহ বা উপগ্রহের মতো দেখতে পেয়েছিলেন, ঠিক যেমন আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদকে দেখি।

অ্যাপোলো ৮ মহাকাশযানটি যখন চাঁদকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছিলো এবং পরবর্তীতে চাঁদে নামার উপযোগী স্থানের সন্ধানে চাঁদের পিঠের ছবি তুলছিলো, তখনই হঠাৎ অভিযানের দলনেতা ফ্র্যাঙ্ক বোরম্যান কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে খেয়াল করলেন চাঁদের দিগন্ত বরাবর ছোট্ট নীল অদ্ভুৎ সুন্দর পৃথিবীটিকে দেখা যাচ্ছে, ঠিক যেন চাঁদের মাটিতে পৃথিবী উদিত হচ্ছে। তখনই তিনি এর একটি ছবি তুললেন সাদা কালো ছবির ক্যামেরায়। তাঁর পাশেই ছিলেন দলের অন্য অভিযাত্রী উইলিয়াম অ্যান্ডার্স। উইলিয়ামের হাতে ছিলো রঙ্গিন ছবির ক্যামেরা, তিনি তুললেন রঙ্গিন ছবি। এই রঙ্গিন ছবিটিই পরে ‘দ্য আর্থরাইজ’ বা পৃথিবীর উদয় নামে বিখ্যাত হয়ে যায়।


উইলিয়াম অ্যান্ডার্সের তোলা দ্য আর্থরাইজ (১৯৬৮), ঘড়ির কাঁটার দিকে নব্বই ডিগ্রী ঘোরানো হয়েছে

স্থির ছবির ইতিহাসে মানবসমাজকে সবচেয়ে প্রভাবিত করেছে যে ছবিগুলো পরবর্তীতে এই ছবিটি সেগুলোর অন্যতম একটি হয়ে ওঠে। কারণ এই ছবিটি দেখেই মানুষ চোখের সামনে দেখতে পেলো পৃথিবী আসলে কত ছোট্ট, বিশাল মহাকাশের গায়ে পৃথিবী কতটা ভঙ্গুর, কতটা নাজুক। যারা এতদিন বিশ্বাস করে এসেছিলো পৃথিবীটা বিশাল, মানুষের যে কোন আঘাত ও চাপ সইবার ক্ষমতা পৃথিবীর আছে, তারা হঠাৎ করেই বুঝতে পারলেন আসলে পৃথিবী খুবই ছোট, মানুষ যদি এই ছোট্ট পৃথিবীটিকে ঠিকমতো যত্ন না নেয়, যদি পৃথিবীর উপর যেমন খুশি অত্যাচার চালায় তবে পৃথিবীর ভেঙ্গে পড়তে খুব সময় লাগবে না। ছবিটি দেখে তারা আরো বুঝতে পারলেন, যদি আমাদের পৃথিবী মানুষের চাপ সহ্য করতে না পেরে মুষড়ে পড়ে, এই বিশাল মহাকাশে ধারেকাছে আমাদের যাবার মতোও আর কোন জায়গা নেই। মানুষ এও বুঝতে পারলো, যে বায়ুমন্ডকে আমরা বিশাল বায়ুর সমুদ্র মনে করতাম, আসলে তা পৃথিবীকে ঘিরে খুবই পাতালা ঠুনকো একটি খোসার মতো, মানুষের কোন কোন প্রযুক্তির যেরকম ক্ষমতা হয়েছে, ঠিকভাবে যত্ন না নিলে এই পাতলা খোসাটি যে কোন সময় ছিড়ে যেতে পারে। নীল সমুদ্র, সবুজ বনানী, সাদা মেঘমালা, আর নীলচে বায়ুমন্ডল দিয়ে ঘেরা এত অপরূপ সুন্দর আর মানুষ বাসের উপযোগী যে আর কোন গ্রহ-উপগ্রহ মানুষের দৃষ্টিসীমায় নেই সেটাও মানুষ উপলদ্ধি করলো। কাজেই শুধু বিজ্ঞানীরা নন, সাধারণ মানুষের মধ্যেই পৃথিবীর প্রতি অদ্ভুৎ একটি মায়া জন্মাতে সাহায্য করলো এই ছবি, যারা পৃথিবীর যত্ন নেয়ার প্রয়োজনের ব্যাপারে এতদিন সন্দেহে ছিলেন তাদেরও অনেকের সে সন্দেহ দূর হয়ে গেল। শক্তিশালী হলো মানুষের পরিবেশ সংরক্ষণের তাগিদ, আন্দোলন ও সংগ্রাম। অনেক বেশি সংখ্যায় মানুষ পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনে যোগ দিতে থাকলেন। আমেরিকা ছাড়িয়ে এই বোধদয় ছড়িয়ে গেলো বিশ্বময়।


তৃতীয় আর একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করবো মানুষের পরিবেশ চেতনা জাগরনের গল্প। তিনি ছিলেন আমেরিকার উপ-রাষ্ট্রপতি (ভাইস প্রেসিডেন্ট)। আট বছর উপ-রাষ্ট্রপতি থাকার পর ২০০০ সালে আবার নির্বাচন করলেন রাষ্ট্রপতি হবার জন্য। প্রায় জিতেও গিয়েছিলেন, কিন্তু দুঃখজনক কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে আদালতের রায়ে তাঁকে রাষ্ট্রপতি হতে দেয়া হলো না, রাষ্ট্রপতি হলেন জর্জ ডব্লিও বুশ। হেরে গিয়ে তিনি রাজনীতি থেকে বিদায় নিলেন, ফিরে গেলেন পড়াশোনা ও ব্যক্তিগত গবেষণায়। অতিমাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমনের ফলে বায়ুমন্ডলের যে তাপমাত্রা বাড়ছে, আর তার ফলে বাড়ছে পৃথিবীর সমুদ্রের পানির উচ্চতা, মানুষের অপিরনামদর্শী কর্মকান্ডের ফলে জলবায়ুর যে পরিবর্তন হচ্ছে আর তার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বন্যা, খরা, ঘুর্ণিঝড়সহ নানা ধরনের দূর্যোগ হচ্ছে এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলোকে তিনি জড়ো করা শুরু করলেন। এর আগেও তিনি এসব বিষয়ে অনেক পড়াশোনা করেছেন, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তখন, ভাইস প্রেসিডেন্ট হবার আগে যখন সিনেটর (সংসদ সদস্যের অনুরূপ) ছিলেন তখনও। যাঁর কথা বলছি তাঁর নাম অ্যালবার্ট আর্নল্ড আল গোর, সংক্ষেপে শুধু আল গোর হিসাবে বেশি পরিচিত।

ছাত্রজীবনেই তিনি পরিবেশের এই বিশেষ সমস্যাটি নিয়ে খুব আগ্রহ বোধ করতে শুরু করেন। পরে যখন আমেরিকার কংগ্রেস (সংসদের নিম্নকক্ষ) ও সিনেটের (সংসদের উচ্চকক্ষ) সদস্য ছিলেন তখন তিনি কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমানোর জন্য সবসময়ই সোচ্চার ছিলেন। যখন তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, তখনও প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে সবসময়ই পরিবেশ সহায়ক আইন তৈরীর কাজে উৎসাহ দিয়েছেন, সহায়তা করেছেন। ২০০০ সালে রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার পর পুরো সময়টাই ব্যয় করতে শুরু করলেন এই উদ্দেশ্যে। বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ব্যাপারে সেসময় পাওয়া সব বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমান এবং পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে এর ক্ষতির অনেক আলামত ছবি ও ভিডিও আকারে তিনি সংগ্রহ করলেন। এসব ছবি, ভিডিও, ও তথ্যগুলো দিয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও যত্ন নিয়ে তিনি বানালেন একটি পাওয়ার-পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন। এই প্রেজেন্টেশনটির সাথে নিজস্ব আকর্ষণীয় ঢংয়ে তিনি দেশে বিদেশে বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে এই বিষয়ে সচেতন করে তোলার কাজ শুরু করলেন। এই একই বক্তৃতা তিনি প্রায় ৪০০ বার দিয়েছেন বিভিন্ন স্থানে। তেমনই একটি টাউন হল মিটিংয়ে তাঁর এই বক্তৃতাটি শুনে ও প্রেজেন্টেশনটি দেখে --- ভাবলেন এই বক্তৃতাটি দিয়েই খুব ভালো একটি তথ্যচিত্র (ডকুমেন্টারী ফিল্ম) বানানো যায়। তাঁরা আল গোরের সম্মতি নিয়ে নিজ উদ্যোগেই যোগাযোগ করলেন চিত্রনির্মাতা ---- এর সাথে। অবশেষে আল গোরের বক্তৃতাটি ‘অ্যান ইনকনভেনিয়েন্ট ট্রুথ’ বা ‘একটি অপ্রিয় সত্য’ নামে তথ্যচিত্র হিসাবে মুক্তি পেলো ২০০* সালে। আর মুক্তি পেতে না পেতেই একেবারে বাজিমাত করে দিল ছবিটি।

Read more