পূর্ববর্তী পর্বসমূহ:
শখের ছবিয়ালের টিপস-০১
শখের ছবিয়ালের টিপস-০২
গত পর্বে সংক্ষেপে বলেছিলাম ক্যামেরা কিভাবে এক্সপোজার নিয়ন্ত্রন করে এবং ফোকাস নিবদ্ধ করে। এবার এ নিয়ে একটু বিস্তারিত। যদি এ পর্বে এসে ভাবতে শুরু করেন এই তত্ত্বগুলোর কী প্রয়োজন, কেন আমি সরাসরি কিছু টিপস দিতে শুরু করছিনা, তার উত্তরে আমি বলবো 'এ জিনিসগুলো বোঝার দরকার আছে আমার সত্যিকারের টিপসগুলো বোঝার জন্য'। আমি যথাসম্ভব টেকনিক্যাল বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা সরল রাখতে চেষ্টা করছি ।
এক্সপোজার:
আগের পর্বে বলেছিলাম শুট বাটনটি অর্ধেক চেপে ধরলে দৃশ্যের আলোর পরিমান বুঝে ক্যামেরা সঠিক এক্সপোজার নির্ধারণ করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আপনি যে দৃশ্যের ছবি তুলছেন তার সব অংশে আলোর পরিমান বা উজ্জ্বলতা সমান নয় - কোন অংশ রোদ, কোন অংশে ছায়া, আবার কোন অংশে উজ্জ্বল রং, কোন অংশে গাঢ় রং। এরকম আলোক ভিন্নতার একটি উদাহরণ হলো আকাশ ও দুরের বন/পাহাড় - আকাশের অংশ অনেক বেশি উজ্জ্বল, নিচে বন/পাহাড় অনেকটাই অন্ধকার। এরকম ভিন্ন ভিন্ন উজ্জ্বলতার অংশ যদি দৃশ্যে থাকে ক্যামেরা কোন অংশের জন্য সঠিক এক্সপোজার নির্ধারণ করবে? যদি উজ্জ্বল অংশের জন্য সঠিক এক্সপোজার নির্ধারণ করতে হয়, তাহলে গাঢ় অংশ অন্ধকার আসবে; আবার গাঢ় অংশের জন্য এক্সপোজার নির্ধারণ করলে উজ্জ্বল অংশ বেশি উজ্জ্বল হয়ে প্রায় জ্বলে যাবে। প্রায়ই আপনারা ছবিতে দেখেন যে আকাশ নীল না এসে সাদা হয়ে যায়, এটা আকাশের অতিরিক্ত এক্সপোজারের জন্যই হয়ে থাকে।
দৃশ্যের কোন অংশ কতটুকু উজ্জ্বল তা বোঝার জন্য ক্যামেরাকে বিভিন্ন অংশ থেকে আসা আলোর তীব্রতা মাপতে হয়। এই মাপার কাজটিকে বলে মিটারিং। প্রায় সব ডিজিটাল ক্যামেরার ক্ষেত্রেই যে পদ্ধতিতে ক্যামেরা মিটারিং করে থাকে তাকে বলে ম্যাট্রিক্স মিটারিং। এর অর্থ হলো দৃশ্যের বিভিন্ন অংশ থেকে যে আলো আসে তা আলাদা আলাদাভাবে ক্যামেরা মেপে নেয়। এরপর ক্যামেরার সফটওয়্যার দৃশ্যের গড় উজ্জ্বলতা থেকে এক্সপোজারের সিদ্ধান্ত নেয়। গড় বলতে যে সবসময় গাণিতিক গড় হবে এমন কোন কথা নেই। এক এক ব্রান্ডের ক্যামেরার এক এক রকমের গড় হিসাব করার পদ্ধতি আছে, সবাই চায় তাদের ক্যামেরা যেন সবচেয়ে বুদ্ধিমত্বার সাথে গড়টি হিসাব করতে পারে, ফলে সবচেয়ে ভালো ছবি আসে। এবং প্রস্তুতকারকরা এই অ্যালগরিদমগুলো সাধারণত প্রকাশ করে না, তাই নিশ্চিতভাবে কোন ক্যামেরা কিভাবে গড় বের করে তা আমরা জানি না। সুখের কথা অ্যালগরিদমটি আমাদের না জানলেও চলবে, শুধু জানতে হবে মিটারিংয়ে কোন প্রকার ভেরিয়েশন ক্যামেরা আমাদের পছন্দ করতে দেয় কিনা। সব সস্তা ক্যামেরা দেয় না, তবে কোন কোন ক্যামেরা কয়েকরকম মিটারিং মোড সেট করতে দেয় - ইভ্যালুয়েটিভ বা ইন্টেলিজেন্ট মিটারিং, সেন্টার ওয়েটেড অ্যাভারেজ মিটারিং, স্পট মিটারিং ইত্যাদি।
* ইভ্যালুয়েটিভ বা ইন্টেলিজেন্ট মিটারিং: এই মিটারিংয়ে দৃশ্যের সব অংশের আলোর তীব্রতাকে বিবেচনায় এনে ক্যামেরা একটি এক্সপোজার নির্ধারণ করে;
* সেন্টার ওয়েটেড অ্যাভারেজ মিটারিং: এই মিটারিংয়ে দৃশ্যের মাঝামাঝি অংশের উপর বেশি জোর দেয়া হয়, অর্থাৎ ক্যামেরা চায় মাঝের অংশের এক্সপোজার যথাসম্ভব সঠিক থাকুক, ছবির চারপাশের অংশগুলোর এক্সপোজার ততটা সঠিক না হলেও চলবে;
* স্পট মিটারিং: স্পট মিটারিংয়ে দৃশ্যের একেবারে কেন্দ্রে যা থাকবে তার উপর ভিত্তি করে এক্সপোজার নির্ধারিত হবে, তাতে ছবির বাকি সব অংশের এক্সপোজার যাই হবে হোক (ওভার বা আন্ডার)।
বাদবাকি ক্যামেরা ব্যবহারকারীর সিদ্ধান্ত তিনি পুরো দৃশ্য সমান গুরুত্ব দিয়ে এক্সপোজ করতে চান নাকি শুধু মাঝখানের কিছু অংশকে প্রাধান্য দিতে চান, নাকি শুধু কেন্দ্রকেই বিবেচনায় আনতে চান। এই সিদ্ধান্ত নির্ভর করে আপনি কিসের ছবি তুলছেন, বাস্তবিক কতটা তারতম্য আছে বিভিন্ন অংশের উজ্জ্বলতার - এসব বিষয়ের উপর। এই তত্ত্বটির ব্যবহারিক প্রয়োগ করা খুব সহজ নয়, তবে জানা থাকলে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিজেই শিখে ফেলা যায় কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে।
ফোকাস:
এ ব্যাপারে আগের পর্বে বলেছিলাম ক্যামেরা অটোফোকাসের সাহায্যে নিজেই দৃশ্যের জিনিসগুলোর উপর ফোকাস নিবদ্ধ করে। যদি সব বস্তু সমান দুরত্বে হয়, ব্যাপারটি খুব সহজ, সেই দুরত্বে ফোকাস করলেই হয়। কিন্তু কোন জিনিস কাছে, কোন জিনিস দূরে হলে ক্যামেরা চেষ্টা করে দুটোকেই ফোকাসে আনতে। কাছে দূরে
সমানভাবে ফোকাস করা কি সম্ভব? উত্তর হ্যা এবং না। 'না' এই জন্য যে, সাধারণ নিয়ম হলো, কাছে ফোকাস করলে দূরের জিনিস ঝাপসা হয়ে যাবে, দূরে ফোকাস করলে কাছের জিনিস ঝাপসা হয়ে যাবে। আবার উত্তর 'হ্যা' এই জন্য যে, তা নির্ভর করে
কয়েকটি বিষয়ের উপর -
১। মূল ফোকাসকৃত বস্তুটি ক্যামেরা থেকে কত দূরে (ফোকাল ডিসট্যান্স)
২। 'কাছে' এবং 'দূরে'-র বস্তুর মধ্যে দূরত্ব কতটা (ডেপথ)
৩। লেন্সের অ্যাপার্চার কত।
যতটা দূরত্বের মধ্যে সব বস্তুই ফোকাসে থাকে তাকে ডেপথ-অব-ফিল্ড বলে। এই ডেপথ-অব-ফিল্ড স্থির নয়, কমে বাড়ে। যদি দুটি বস্তুর দূরত্ব ক্যামেরার ডেপথ-অব-ফিল্ড -এর চেয়ে কম হয় তাহলে উভয় বস্তুই ফোকাসে আনা সম্ভব। এই বিষয়ক আরেকটু আলোচনা করতে পারলে ভালো হতো, তবে নিরস হয়ে যাবে মনে করে আপাতত বাদ দিয়ে গেলাম, পরে কখনো প্রয়োজন মনে করলে লিখতেও পারি।
আপনার দৃশ্যে ক্যামেরা যখন দেখবে বস্তুগুলো কাছে-দূরে আছে, তখন ক্যামেরা নিচের দুটির যে কোন একটি কাজ করবে -
১। ডেপথ-অব-ফিল্ড বাড়িয়ে সবগুলোকে
ফোকাসে আনার চেষ্টা করবে। সেটা করা সম্ভব লেন্সের পর্দার ছিদ্রটি (অ্যাপার্চার) ছোট করে (বড় f সংখ্যা)। অ্যাপার্চার কমালে আলো কমে যাবে, তাই আলো ঠিক রাখার জন্য একই সাথে ক্যামেরা এক্সপোজার টাইম বাড়িয়ে দেবে (শাটার স্পীড কম)। ISO যদি Auto-তে থাকে ISO speed বাড়িয়েও কমে যাওয়া এক্সপোজারকে ঠিক করতে পারে ক্যামেরা।
২। প্রথম প্রক্রিয়াটি যদি সফল না হয় (প্রধানত লেন্সের সীমাবদ্ধতার কারণে), তখন
ক্যামেরা যে কোন একটি বস্তুকে ফোকাসে এনে অন্যটিকে ফোকাসের বাইরে রাখবে। এই সিদ্ধান্তটি আপনার পক্ষে নেয়া যত সহজ, ক্যামেরার পক্ষে সহজ নয়; কারণ আপনি জানেন দৃশ্যের কোন জিনিসটি আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, ক্যামেরার জানার কথা নয়। তবু আজকালকার ক্যামেরাগুলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করে কোন জিনিসটি কী - কোনটি মানুষ, কোনটি ফুল, কোনটি আপাতদৃষ্টিতে অনুল্লেখ্য বা সাবজেক্ট হিসাবে কম গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক ক্যামেরা আছে বাটনটি অর্ধেক চাপলে দৃশ্যের কোথায় কোথায় ফোকাস করার চেষ্টা করছে তা আপনাকে দেখাবে। যদি আপনার সেসব মনপুত না হয়, একটু ভিন্ন দুরত্ব বা ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে আবার ফোকাস করার চেষ্টা করুন। অনেক ক্যামেরায় ফেস ডিটেকশন প্রযুক্তি আছে, দৃশ্যে যেখানেই মানুষের চেহারা দেখা যাবে সেখানেই ক্যামেরা ফোকাস করার চেষ্টা করবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্যামেরার পছন্দ আপনার পছন্দের সাথে মিলে যাবে, তবে এমনও পরিস্থিতি হয় যখন আপনি যে জিনিসটি ফোকাস করতে চাইছেন, ক্যামেরা কিছুতেই সেই জিনিসটি ফোকাস করছে না। তখন ক্যামেরাকে 'বোকা বানিয়ে' ফেলতে হয়, অর্থাৎ ক্যামেরার এই স্মার্ট বা ইন্টেলিজেন্ট অপশানটি বন্ধ করে দিতে হয় (সব ক্যামেরায় বন্ধ করা নাও যেতে পারে)। ইন্টেলিজেন্ট অটোফোকাস বন্ধ করে দিলে ক্যামেরা শুধুমাত্র দৃশ্যের কেন্দ্রে যা আছে তাকেই ফোকাস করে (সেন্টার ফোকাসিং)। এবার আপনি যে জিনিসটি ফোকাস করতে চান তাকে ভিউ-র ঠিক কেন্দ্রে এনে বাটনটি অর্ধেক চাপুন, এভাবে আপনার কাঙ্খিত জিনিসটির উপর ফোকাস নিবদ্ধ হবে।
লক:
এখন সমস্যা হলো আপনার কাঙ্খিত বস্তুটি সবসময় ছবির কেন্দ্রে থাকুক এটা আপনি চাইবেন না, এমনকি ভালো কম্পোজিশনের জন্য মূল সাবজেক্টকে অফ-সেন্টার রাখার কথা বলা হয় (রুল অব থার্ড)। আবার লক্ষবস্তুকে অফ-সেন্টারে রাখলে অন্য কিছু চলে আসবে কেন্দ্রে, ও ফোকাসে। এই সমস্যা থেকে পরিত্রানের জন্য আমার জানামতো সব ক্যামেরাতেই একটি বিশেষ ব্যবস্থা আছে, তার নাম ফোকাস ও এক্সপোজার লক। আপনি যখন বাটনটি অর্ধেক চাপেন তখন শুধু যে ফোকাস ও এক্সপোজার নির্ধারিত হয় তাই নয়, বাটনটি ছেড়ে না দেয়া পর্যন্ত যে ফোকাস ও এক্সপোজার নির্ধারিত হয়েছে তা অপরিবর্তিত (লক্ড) থাকে। কাজেই লক্ষ্যবস্তুকে কেন্দ্রে রেখে বাটনটি অর্ধেক চেপে ফোকাস করুন, এবং বাটনটিকে অর্ধেক চেপে রেখেই ক্যামেরার মুখ সামান্য ঘুরিয়ে বস্তুটিকে অফ-সেন্টারে (ছবির ফ্রেমে আপনার কাঙ্খিত অবস্থানে) নিয়ে আসুন, এবার বাটনটি পুরো চেপে দিয়ে ছবিটি তুলে ফেলুন। এই পুরো প্রক্রিয়ায় একবারও বাটনটি ছেড়ে দেবেন না, দিলেই ফোকাস ও এক্সপোজার নড়ে যাবে।
Copyright 2010 সাইদুর রহমান চৌধুরী
Theme designed by Lorelei Web Design
Blogger Templates by Blogger Template Place | supported by One-4-All
0 comments:
Post a Comment