কিছুকাল আগে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন রিডার্স ডাইজেস্ট বিশ্বের ছত্রিশ মহানগরে মানুষ কত নম্র-ভদ্র তার পরীক্ষা চালিয়েছিলো। সবচেয়ে বেশি আশি পয়েন্ট পেয়ে শীর্ষ ভদ্র নগরের টাইটেল পেয়েছিলো ন্যুইয়র্ক, আর বত্রিশ পেয়ে সবার নিচে ছিলো মুম্বাই। তারা অবশ্য বলেনি সবচেয়ে অভদ্র নগর, তারা বলেছিলো 'সবচেয়ে কম সজ্জন'। ভারতের সবচেয়ে 'আধুনিক' নগরী বলে পরিচিত মুম্বাই-এর যদি এই হাল হয়, অন্য নগরীগুলোয় পরীক্ষাটি চালালে কি ফলাফল হতে পারত; তা বলতে যাওয়া একেবারেই অনুমাননির্ভর হয়ে যাবে। ঢাকার ব্যাপারেও তাই, কারণ এখানেও পরীক্ষাটি চলেনি। বলে নেয়া ভাল, যে নগরগুলো থেকে রিডার্স ডাইজেস্ট প্রকাশিত হয় শুধু সেগুলোই জরীপের আওতায় এসেছিলো।


অতএব, ঢাকা, ব্যাপকার্থে বাংলাদেশের সব নগরীর অধিবাসিরা কতটা নম্র, ভদ্র ও সজ্জন তার ব্যারোমিটার রিডিং আমাদের হাতে নেই। আমাদের সমাজবিজ্ঞানী, সমাজ-মনোবিদ, স্নাতক গবেষক বা মিডিয়া কোন জরীপ চালিয়েছে কিনা বলতে পারছি না। তবে আমার আশংকা, আমরা মুম্বাইয়ের চেয়ে বেশি নম্বর হয়তো পেতাম না। এ কারনে বলছি যে আমার দু'বছর বসবাসের অভিজ্ঞতায় যে ব্যাংককের পথচলতি অপরিচিত সাধারণ মানুষের ভদ্রতা-সৌজন্যে আমি অভিভূত ছিলাম, তারা স্কোর করেছে মাত্র পঁয়তাল্লিশ, স্থান ছাব্বিশ। এশিয়ার অন্য নগরীগুলোর অবস্থা এরকমই - কুয়ালালামপুর (৩৭), সিঙ্গাপুর (৪২), জাকার্তা ও তাইপে (৪৩), হংকং (৪৫), ম্যানিলা (৪৮)। তবে কি জরীপে কোন পশ্চিমা পক্ষপাত ছিলো? হতে পারে ছিলো, তবে আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হল ইচ্ছাকৃত কোন পক্ষপাত নয়, এশিয়ান আর পশ্চিমা সৌজন্যের কায়দা যে ভিন্ন তা ধরতে ব্যর্থ হওয়ায় জরীপের নির্দেশকগুলো এশিয়ার অনুকূলে যায়নি।

কি ছিলো নির্দেশকগুলো?

এক. অফিস রেস্তোরা বা অন্য কোন বদ্ধঘরে ঢোকার সময় আপনার ঠিক পিছু পিছু আসা সম্পূর্ণ অপিরিচিত লোকটির (পুরুষ ও মহিলা) জন্য আপনি দরজা খোলা অবস্থায় ধরে রাখেন, নাকি তার নাকের ওপর দরজাটি বন্ধ হয়ে যেতে দিয়ে নিজের মত ঢুকে পড়েন। (আমাদেরতো বেশিরভাগ অফিস রেস্তোরার দরজা হাট খোলাই থাকে, ঢাকায় পুরো পরীক্ষাটিই ফেল মারতো, কি বলেন? অবশ্য শীতাতপ এলাকায় চলতে পারে।)

দুই. আপনি মাঝারি রকমের কাজে ব্যস্ত আছেন, খুব যে সিরিয়াস তা নয়। আপনার পাশেই অপরিচিত একজন হাত ফসকে ফাইলভর্তি কাগজপত্র বা টুকিটাকি ভর্তি খোলা ব্রিফকেস/পার্স উল্টে ফেললেন মেঝেতে। আপনি কি তাকে জিনিসগুলো গুছিয়ে নিতে সাহায্য করেন, নাকি নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকেন (অথবা ব্যস্ততার ভান করেন)।

তিন. ধরুন আপনি একজন দোকানী (ঠিক মুদি দোকান ভাবতে পারছিনা আমি, ধরুন অভিজাত এলাকার কোন কনভেনিয়েন্স স্টোর)। এমন একজন খরিদ্দার আসলেন যাকে আগে কখনো দেখেননি, এলাকায় থাকে বলেও মনে হয়না, আবার কোনদিন আসবেন তারও সম্ভাবনা ক্ষীণ। তিনি কিছু জিনিস কেনাকাটা করে বিদায় নেবার সময় আপনি কি তাকে ধন্যবাদ (বা সুন্দর করে বিদায় সম্ভাষণ) জানান, নাকি "ধূর! রেগুলার কাস্টমাররে তোয়াজ কইরা কূল পাইনা!" গোছের চিন্তা করেন।

বিশেষত শেষ নির্দেশকে আমরা মার খাব, কারন এশিয়ানরা পশ্চিমাদের মত কথায় কথায় 'দুঃখিত', 'ক্ষমা করবেন', 'ধন্যবাদ' শব্দগুলো ততটা ব্যবহার করেনা, নীরব অভিব্যক্তি দিয়েই কাজ চালায়। ইদানীং অবশ্য শব্দগুলোর প্রচলন আমাদের দেশেও কিছুটা বেড়েছে বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা। তবে আমি গভীরভাবেই মনে করি আমাদের দোকানীরা ক্রেতাদের সঠিক সৌজন্য দেখান না। "এই যে ভাই, জিনিসটা একটু দেখাবেন?" -এর জবাব আসে, "ছয় হাজার টাকা, কিনবেন? কিনলে বলেন নামাই।" অথবা মলিন পোশাকের ক্রেতা হলে জবাব আসবে "আপনি কিনতে পারবেন না, হুদাই কষ্ট দিয়েন না"।

"কত দাম?" -এর জবাব আসে "কিনবেন? কিনলে দাম বলি।"
"এর দাম তো এত ছিলোনা!" -র প্রতিক্রিয়া আসে "কয় বচর হয় বাজারে আইচেন?"

আরো আরো সংলাপের মধ্যে আছে-
"অন্য দোকান দেখেন"
"কিনবেন না তো দর করলেন কেন?"

চরম অপমানসূচক সংলাপের মধ্যে আছে-
"আপনারে বেচলেও এটার দাম হবো না"
"এই জিনিস চোখে কোনদিন দেখছেন, না হুন্নাই দৌড় দিছেন"

চট্টগ্রামের বৃহত্তম ও দেশের অন্যতম বৃহৎ বিপনীকেন্দ্র রেয়াজুদ্দীন বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় প্রায় প্রতি সেকেন্ডের ঘটনা। প্রায়ই এখানে কোন না কোন ক্রেতা দলবদ্ধ দোকানীদের হাতে শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হন। অথচ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই উভয় পক্ষ থেকেই বিনীত প্রত্যুত্তর দেবার সুযোগ থাকে।

... ... ...

ভাগ্যিস জরীপটি আমাদের এখানে হয়নি!!!

... ... ...

(আরো কিছু ভাবনা ছিলো, এখন আর লিখতে মন চাইছে না... অন্য কোন দিন।)

0 comments:

Post a Comment