ইন্টারনেট শব্দের বাংলারূপ ‘আন্তর্জাল’ দেখে মাঝে মাঝেই থমকে যাই। Inter+national থেকে যেমন আন্তর্জাতিক (অন্তর+জাতি+ইক) এসেছে, ধারণা করি একই সূত্র প্রয়োগ করে Inter+Net –কে আন্তর্জাল (অন্তর+জাল) বানানো হয়েছে। যেখানে বাংলা ভাষায় এখনো কোন ব্যাকরণই রচিত হয়নি, সেখানে শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অভিধান এখনই আশা করি না; কাজেই শব্দটির ব্যুৎপত্তি কোথায় ও কিভাবে, কে করেছেন তার হদিস সন্ধান করা সহজ কাজ হবে না আগেই বুঝে নিয়েছি। গুগল দিয়ে সামান্য ঘাটাঘাটি করেও বুঝলাম ‘আন্তর্জাল’ শব্দটির ব্যুৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে কোন সাহায্য আপাতত পাচ্ছি না।



এবার বলি কেন থমকে যাই। আন্তর্জাল যদি ‘অন্তর’ এবং ‘জাল’ দিয়েই হয়ে থাকে, তাহলে সম্ভবত একটি ভুল শব্দ তৈরী করা হয়েছে। যে ‘নেট’ এর বাংলা অর্থ জাল, ইন্টারনেটের ‘নেট’ সেই ‘নেট’ নয়। এটি এসেছে নেটওয়র্কের সংক্ষিপ্ত রূপ হিসাবে। ইংরেজিতে শব্দকে সংক্ষেপ করে লিখার প্রচলন আছে, যেমন, ক্যামেরা-কে ‘ক্যাম’, তাহলে সংক্ষেপিত ‘নেটওয়র্ক’-কে ‘নেট’ ধরে নিয়ে ‘জাল’ বানিয়ে ফেলা কতটা যৌক্তিক প্রশ্ন উঠতেই পারে। ‘নেটওয়র্ক’-এর কোন বাংলা প্রতিশব্দ নেই বলেই হয়তো এটা করা হয়েছে। তাহলে আবার প্রশ্ন করাই যায়, ‘নেটওয়র্ক’-এর বাংলা না করেই কেন ‘ইন্টার-নেটওয়র্ক’ নিয়ে টানাটানি? ‘নেটওয়র্ক’-এর একটি বাংলা প্রতিশব্দ হলেইতো তাকে ‘অন্তর’-এর সাথে জুড়ে দিয়ে ‘ইন্টারনেট’-এর বাংলা পাওয়া যেতো! তা না করে যে ‘জাল’ শব্দটিকে জুড়ে দেয়া হয়েছে, বাংলায় সেই ‘জাল’ শব্দটির প্রচলিত অর্থ কদাচিত নেটওয়র্ক বোঝাতে ব্যবহার হলেও তার কোন আভিধানিক স্বীকৃতি আমার চোখে পড়েনি।

তর্কের খাতিরে হয়তো বলা যায়, একটি বাংলা প্রতিশব্দ দরকার, তাই এটি করে দেয়া হয়েছে, ব্যবহার করতে করতে করতে তা স্বীকৃত হয়ে যাবে, অভিধানেও অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে একদিন। যদি বলা হয়, অমুক বিখ্যাত কবি বা সাহিত্যিক ইন্টারনেটের বাংলা করেছেন ‘ৎষঃ’, আমরাও তাই এটাই ব্যবহার করি, তাহলে এখানেই আমার রচনার ইতি। আর যদি বলা হয়, না, অর্থবোধক বাংলা প্রতিশব্দ চাই যা প্রতিষ্ঠিত অন্য বাংলা শব্দের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে, তাহলে ‘আন্তর্জাল’ কে স্বীকার করে নিতে দুই কারণে আমার আপত্তি। প্রথম কারণ এতক্ষণ আলোচনা করলাম – মূলশব্দগত ভুল। দ্বিতীয় কারণ, কম্পিউটার, সিডি, ডিভিডি, ড্রাইভ, প্রিন্টার, স্ক্যানার, ডিজিটাইজার, ট্যাবলেট, মাউস, পেনড্রাইভ –এরকম আরো শত শত প্রযুক্তি বিষয়ক শব্দের যদি বাংলা প্রতিশব্দ করার দরকার না পড়ে, ইন্টারনেটের একটি ভুলভাল বাংলা করার কী দরকার পড়েছিলো?

প্রসঙ্গক্রমে বলি, অনেকেই বলে থাকেন ‘মুঠোফোন’ বাংলাটি খুব চমৎকার ও যুৎসই হয়েছে। আমি ভাবছি, চমৎকার হয়তো হয়েছে, কিন্তু বাংলা হয়েছে কি? ‘ফোন’-টিইতো বাংলা নয়। যদি মুঠোফোনের ‘ফোন’-কে বাংলা ভাবতে দোষ না থাকে ‘নেট’-কে বাংলা ভাবতে দোষ কোথায়? ইন্টারনেটকে আন্তর্নেট বললেই বা কী ক্ষতি ছিলো? অন্তত ভুল তো হতো না।

তর্কের খাতিরে হয়তো আবার বলা হবে, ওয়েব অর্থ ‘জাল’, তাই আন্তর্জাল ঠিক আছে। কিন্তু ইন্টারনেট প্রযুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই জানেন যে ‘ওয়েব’ ইন্টারনেট প্রযুক্তির একমাত্র বাস্তবায়ন নয়, ‘ওয়েব’ ছাড়াও আরো বহুমাত্রিক ব্যবহার আছে ইন্টারনেটের।

প্রাসঙ্গিক আরো কিছু প্রশ্ন আমার মনে চলে আসে, যেমন-

১. কম্পিউটার যদি গণকযন্ত্র হয়, ক্যামেরার ছবিযন্ত্র হতে দোষ কোথায়?

২. ব্লগের বাংলা যদি খেরোখাতা (খেরুয়া খাতা) হয়, নোটবুক বা স্ক্র্যাপবুক তাহলে কী? বাংলায় খেরুয়া খাতা হিসাবে যে লাল কাপড়ের মলাটের খাতা পাওয়া যেতো এককালে, ইংরেজের দুনিয়ায় তারই নাম ছিলো স্ক্র্যাপবুক। সেই স্ক্র্যাপবুক আর ব্লগতো সমার্থক নয়, বাংলায় কেন জোর করে তাদের সমার্থক করার চেষ্টা?

৩. ডিজিট যদি বাংলায় ‘অংক’ (০-৯) হয়, ডিজিটাল কেনো ‘সংখ্যা বিষয়ক’ হবে, তার তো ‘অংক বিষয়ক’ হওয়ার কথা!

৪. ইন্টারনেটকে যদি আন্তর্জাল বলতেই হয়, ইলেকট্রনিক মেল (ই-মেল) কে কেন ‘বিদ্যুতিন পত্র (বি-পত্র)’ বলি না? একই ভাবে ই-বুক না বলে বি-বই কেন বলি না?

৫. হোমপেজ-এর বাংলা ‘নীড়পাতা’ বেশ ভালো ও সঠিক হয়েছে বলেই আমারো বিশ্বাস। কিন্তু তাহলে ওয়েবপেজ কি ‘জালপাতা’ হবে? ওয়েবসাইট কি হবে – জালস্থান, জালজমি, জালভূমি?

আমাদের বুঝতে হবে যে সব কিছুর বাংলা করা যাবে না, অন্তত আক্ষরিক অর্থ ধরে ধরে তো নয়ই। যদি তাই হতো তাহলে -
১. tele অর্থ দূর, vision অর্থ দৃষ্টি, television হতো দূরদৃষ্টি
২. universe অর্থ বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড, universal হয়েছে সার্বজনীন (বৈশ্বিক নয়)
৩. globe পৃথিবী বুঝালেও global হয়েছে বৈশ্বিক, পার্থিব নয়

কাজেই ইন্টারনেটও আমি মনে করি আন্তর্জাল নয়, অন্য কিছু, যার অপেক্ষায় আমি আছি – যতক্ষণ তা না আসছে ততক্ষণ ইন্টারনেট ইন্টারনেটই।

2 comments:

  1. Unknown

    Dear Admin Sir,

    Internet er Bangla meaning ki atai hobe ??? Please Advice If you get any update.

    Thanks & Regards,

    Apu Das.

    April 17, 2016 at 11:16 PM
  2. Tanmoy Mukherji

    খুবই সঠিক এবং বাস্তব। জোর করে কিছু কিছু শব্দের বাংলা ক'রে, সেই শব্দের মূল অর্থই হারিয়ে যায়। নেটওয়ার্ক কী করে যে জাল হয় তা আমার মোটামাথায় ঢোকে না। তাহলে মাউস্ এর বাংলা ইঁদুর বলতে আপত্তি কোথায়? হেডফোন কে মাথাভাষ বলা যায় কি? সব শব্দের বাংলা করতেই হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? রবীন্দ্রনাথ তো কালেজ লিখেছেন, তো কই আমরা তো কালেজ বলি না। ওদিকে সেমিনার, মিটিং, চেয়ার গ্লাস বলতে আপত্তি নেই, কিন্তু ইন্টারনেট কে অন্তর্জাল / আন্তর্জাল বলতেই হবে! আশ্চর্য ব্যাপার। আপনার লেখাটি বড়ই বাস্তব। ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।

    May 13, 2021 at 4:52 AM

Post a Comment