পথচলতি-০৪

Written by Sayedur R Chowdhury 0 comments Posted in:

আরো একঘন্টা বেশি দেশে থাকতে পারার যে আশাটা মনে জেগেছিলো খুব মন খারাপ করে দিয়েই তা উবে গেলো। আমার যাত্রাসারনীতে যে সময় দেয়া আছে তা নিয়ে দ্বিধায় পড়েছিলাম - কারণ টিকেট যখন কিনেছি তখন ঘড়ি কার্যকর ছিলো স্টান্ডার্ড বিএসটি-তে, আর এখন কার্যকর ডে লাইট সেভিং - একঘন্টার হেরফের। আশা করেছিলাম যা সময় দেয়া আছে তার সাথে একঘন্টা যোগ করতে হতে পারে, কিন্তু আমার ক্যারিয়ার এয়ারলাইন্সের স্থানীয় অফিস থেকে জানা গেল সারনীর সময় অনুযায়ীই বিমান ছাড়বে। যাত্রার সময়টিও একেবারেই বাজে - ভোর ছ'টার কিছু পরে, মানে ভোর চারটা
নাগাদ বিমানবন্দরে পৌঁছে যাওয়া উচিত। একটাই সুবিধা পেলাম - রমজানের কারণে সেহরীতে এমনিতেই সবাই উঠবে, শুধু আমার জন্য কারো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে হবে না।

বোনের গাড়িতে লিফটের আশা ছিলো - ঠিক আগেরদিনই চালক মহাশয়কে কোন গুরুতর কারণে তাৎক্ষণিক বিদায় করে দেয়া হয়েছে, আচমকা বেকায়দায় পড়ে গেলাম। ভোররাতে কোন বন্ধুকে গাড়ির জন্য বিব্রত করতে ইচ্ছা হলো না, তাই বেলা থাকতেই একটা ভাড়ায় খাটা ভ্যান ঠিক করে এলাম। ভ্যানের একটা সুবিধা পাওয়া গেল, যারা যারা আমাকে বিদায় জানাতে বিমানবন্দর যেতে চায় সবারই জায়গা হয়ে গেল।

ড্যাকফোবিয়ার কারণেই বন্ধুর সহকর্মীদের একজনের সাথে আগেই যোগাযোগ করা আছে আমার যাবার সময় বিমানবন্দরে সাহায্য পাবার উদ্দেশ্যে। ডিপার্চার টার্মিনালে পৌঁছে তাকে ফোন দিতেই বলে দিল কোন গেট দিয়ে ঢুকতে হবে। তিনি নিজেই বেরিয়ে এসে আমার ব্যাগ ট্রলি ভরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি ঢুকলাম একটু পরে। ভোররাত হলেও বিমানবন্দরে ব্যস্ততার কিছুমাত্র হেরফের নেই, অনেক বছর আগে এমন ছিলো না। আগে বিমানবন্দরের ব্যাংকবুথও বন্ধ হয়ে যেতো বিকাল পাঁচটায়, পরদিন সকাল হবার আগ পর্যন্ত যারা বিমানবন্দর ব্যবহার করতেন তাঁদেরকে কারেন্সি লেনদেন করতে হতো দালালের সাথে। সে হিসেবে অনেকটাই উন্নতি হয়েছে গত দশ বছরে। টার্মিনালও বাড়িয়ে অনেক বড় করা হয়েছে, আগের প্রায় দ্বিগুণ। চাকচিক্যও বেড়েছে, আগের চেয়ে পরিচ্ছন্নতাও - টয়লেটে কমোড ওভারফ্লো হয়ে নোংরা পানিতে ফ্লোর ভেসে যেতে দেখিনি গত কয়েকদফা। অন্তত লন্ডনের হিথ্রো তিন নম্বর টার্মিনাল থেকে অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন - এটা ভেবে খুবই ভালো লাগলো।

বোর্ডিং নিতে এসে দেখি বেশ বড় লাইন, লন্ডন, নিউইয়র্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের যাত্রীই বেশি। হাতে যথেষ্ঠ সময় আছে, তাই উদ্বেগহীন দাড়িয়ে গেলাম লাইনের পেছনে। সচরাচর বিমানবন্দরে আমি নারী কর্মী ও অফিসারদের এড়িয়ে চলি - তাঁরা একটু বেশি খুঁতখুঁতে হন, জেরা করতে পছন্দ করেন, এবং নিয়মের বাইরে না যাবার ব্যাপারে সবসময়ই কঠোর, খুঁটিনাটি অসঙ্গতিও নারী অফিসারদের নজর এড়িয়ে যায় না। প্রধানত পুরুষনিয়ন্ত্রিত পৃথিবীতে একজন পুরুষ যাত্রীর ওপর নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করার একটা প্রচ্ছন্ন ব্যাপারও থাকতে পারে, মনোবৈজ্ঞানীক গবেষণা ছাড়া নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে যাই থাকুক পেছনে, নারী অফিসাররা বিমানবন্দরগুলোয় পুরুষদের চেয়ে বেশি এফিশিয়েন্ট এটা আমি সবসময়ই মানি। আমার লাইনের শেষপ্রান্তে দেখতে পেলাম একজন নারী অফিসার বোর্ডিং দিচ্ছেন - ব্যাগের ওজন নিয়ে কোন সংশয় নেই, সাথে সাহায্যকারী আছে, তাই নারী-পুরুষ নিয়ে মাথা আর ঘামালাম না।

আমার পালা যখন এলো, ঠিক তখুনি কিছু একটা সমস্যা হয়েছে কম্পিউটারে - অনেক সময় লাগলো আমার ব্যাগগুলো চালান হয়ে যেতে। বিরক্ত হয়ে টিকেট ফেরত দেয়ার সময় অফিসার ঘোষনা করলেন - এই শেষ! সেহরীর সময় চলে যাচ্ছে, বাকী যাত্রীদের সেহরীর খাবার খেয়ে এসে বোর্ডিং দেবেন। যাক বাবা, বাঁচা গেল; আমার পরেরজনের চেহারাটা দেখার মতই হয়েছিলো, আরেকটু হলে আমারই ওরকম হতো। ভদ্রমহিলা চলে যেতেই খেয়াল করলাম আমার টিকেট-পাসপোর্ট দেয়া হয়েছে ঠিকই, তবে বোর্ডিং পাসই না দিয়ে চলে গিয়েছেন তিনি। ঘোরাঘুরি করে বিশ মিনিট পরে যখন আবার এলাম, মহিলা বললেন - সরি, সেহেরীর তাড়াহুড়ায় ভুলে পাসগুলো ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম। আমার সাহায্যকারীর দিকে ঘুরে বললেন, সালামকে দিয়ে ভিতরে পাঠিয়ে দিয়েছি, ইমিগ্রেশনে তাকে পাবা।

ইমিগ্রেশনের পর হাতের পানির বোতলটা শেষ করে রওয়ানা হলাম বোর্ডিং গেটের সিকিউরিটি চেকিংয়ে। সঙ্গীর ফোনটি চেয়ে নিয়ে তখনো বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষমান আমার পুত্র-কণ্যাকে বাসায় ফিরে যেতে বললাম - এরকম মুহুর্তে কথা হয় অনেক কষ্ট নিয়ে। তারচেয়েও বেশি কষ্ট নিয়ে ঢুকে পড়লাম ব্রীজের গোড়ায় ওয়েটিং লাউঞ্জে। পাঁচ কেজির ব্যাকপ্যাকটিকে তখন আধমন ওজনি মনে হতে থাকে।

(অসমাপ্ত)

0 comments:

Post a Comment